ঢাকা: চলে গেল আরও একটি ঘটনাবহুল বছর। বিশেষকরে বেশ কিছু রায় এবং এর বাস্তবায়ন বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য।
১. বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর
বছরের শুরুতে ২৭ জানুয়ারি কার্যকর করা হয় বহুল প্রতিক্ষিত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসি। ওই রাতে এক এক করে ফাঁসি দেওয়া হয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা বজলুল হুদা, একে মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ারকে।
তবে এ ফাঁসি কার্যকর করার আগে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের এবং তা খারিজ, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, ফাঁসির দিনক্ষণ নির্ধারণ- এসব নিয়ে দেখা দেয় নানা বিতর্ক। আর বিতর্কের শুরু হয় ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পরপরই।
২. খালেদা জিয়ার বাড়ি
রাজনৈতিক ইস্যু বিবেচনায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার ঘটনাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত। আদালতের রায় অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার পর ২৪ ঘণ্টা ছিল বেশ উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর ক্রন্দনরত মুখ দেখে অসংখ্য নেতাকর্মী সেদিন নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। পরদিন হয় বিএনপির ডাকে হরতাল।
এর আগে ১৩ অক্টোবর বিচারপতি নাজমুন আরা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের হাইকোর্ট বেঞ্চ সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার নোটিসের বৈধতা নিয়ে করা রিট খারিজ করে দেন। রায়ে বাড়ি ছাড়ার জন্য বেধে দেওয়া হয় ৩০ দিন।
৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর এই বছরের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বপক্ষে থাকলেও আলোর দেখা মেলেনি বছরের প্রথম ছয় মাসে। শঙ্কা ছিল আদৌ যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পাবেন কিনা- এ নিয়ে। অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল- এটিও হয়তো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শেষমেশ ‘আই ওয়াশে’ পরিণত হবে। তবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ২৯ জুন গ্রেপ্তারের পর সেই শঙ্কা খানিকটা হলেও লাঘব হয়। এরপর বাকি ছিল চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের অপেক্ষা। ১৩ জুলাই ওই দুইজনকেও করা হয় গ্রেপ্তার। তবে এ মামলায় যে ব্যক্তিটির গ্রেপ্তার নিয়ে খোদ সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল সেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও অন্য একটি মামলায় ১৬ ডিসেম্বর করা হয় গ্রেপ্তার। এর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়ও তাকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়। আরেক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কয়েকদফা ট্রাইব্যুনারে হাজির করার নির্দেশ দিলেও অসুস্থতার কারণে তাকে হাজির করা হয়নি। অবশেষে গত ২ নভেম্বর তাকে হাজির করা হলে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটক রাখার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। তবে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত জমা দিতে না পারায় ২৯ ডিসেম্বর আবারও ২০১১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাঈদীকে আটক রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।
৪. সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ:
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এই রায়ের ফলে খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসন অবৈধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত শাসনকালের কিছু কাজকে হাইকোর্ট মার্জনা করেন রায়ে। এছাড়া সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার বিধান আবার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেতা’ পুনর্স্থাপিত হয়।
৫. সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ:
২৬ আগস্ট সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। এই রায় অনুযায়ী ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের জারি করা সামরিক শাসন, এরপর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সব সামরিক আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন আদেশ ও সামরিক আইন নির্দেশ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা অন্য কোনো কর্তৃপরে আদেশ অবৈধ। তবে বিশৃংখলা এড়ানোর জন্য পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে এরশাদের আমলের কর্মকাণ্ডকে মার্জনা করা হল।
৬. চার বিচারপতির শপথ:
৪ নভেম্বর বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি, দিনভর সভা, বিক্ষোভ মিছিলের মধ্যেই হাইকোর্টের চার অস্থায়ী বিচারপতিকে শপথ পড়ান প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
১১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টে ১৭ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মো. রুহুল কুদ্দুস ও মো. খসরুজ্জামানকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম শপথ পড়াননি। হত্যা মামলার আসামি ও সুপ্রিম কোর্টে ভাঙচুরে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে তাদের শপথের বিরোধিতা করে আসছিলো আইনজীবী সমিতি। নতুন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল দায়িত্ব নেয়ার পরই দুই বিচারপতির শপথের বিষয়টি সুরাহার উদ্যোগ নেন।
৭. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ:
৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি আবু শাহ নাঈম মমিনুর রহমানের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হককে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। এ ঘটনার পর আদালত প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের আইনজীবীরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি রাজপথেও বিক্ষোভ দেখায়।
৮. প্রধানমন্ত্রীর সব মামলা বাতিল:
জোট সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে ফ্রিগেট ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলা ১৮ মে বাতিল করে দেন আদালত। এর আগে বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিগ ২৯, নাইকো, নভোথিয়েটার সংশ্লিষ্ট ৩টি মামলা, মেঘনা ঘাট পাওয়ার প্লান্ট, বার্জ মাউন্টেড এর মামলাগুলি বাতিল করে দেন।
৯. তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা নিয়ে শুনানি:
৬ ডিসেম্বর শুরু হয় কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলের শুনানি। এর আগে ২ ডিসেম্বর গোপন বিচারের বৈধতা নিয়ে জারি করা রুল শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
১০. বোরকা পরা বাধ্যতামূলক নয়:
২২ আগস্ট কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক না করার নির্দেশ দেন আদালত। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে মেয়েদের বিরত না রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে এত রায় আর তা বাস্তবায়নের পরও বছরের শেষে এসে বিচার বিভাগকে খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন। ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংস্থাটির জরিপে বলা হয়- ১৩টি সেবা খাতের মধ্যে শতকরা ৮৮ জন বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১০