ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গারো পাহাড়ে উলফার ১৩ ক্যাম্প

প্রকাশ্যেই সামরিক ট্রেনিং!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১০

ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় গড়ে তুলেছে ১৩টি ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যে চলছে তাদের সামরিক ট্রেনিং।

এই ১৩টি ক্যাম্পের প্রধান কমান্ডার রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মাসুদ রঞ্জন চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি এক সহযোগীসহ র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন। গারো পাহাড়ের আদিবাসী গ্রামগুলোতে লোকে তাকে ‘মাসুদ রঞ্জু চৌধুরী’ নামেই বেশি চেনে।

গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উলফার এসব ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলো হচ্ছে: গজনী রাঙ্গা বুড়ি বাড়ির ক্যাম্প,বাঁকাকুড়া ক্যাম্প,বড় গজনীর খ্রিস্ট বাড়ির ক্যাম্প,টিলাপাড়া ক্যাম্প,বালিয়াজুরী সীমান্ত ক্যাম্প,নলচাপড়া নার্স বাড়ির ক্যাম্প,হালুয়াঘাট মনিকুড়া সুশীল দ্রং এর ক্যাম্প,রামচেঙ্গা ক্যাম্প,দুর্গাপুর কোচপাড়া টিলা ক্যাম্প,সন্ধ্যাকুড়ি রাবার বাগানের রবিন ক্যাম্প,ধোবাউড়া ক্যংপাড়া কাব ক্যাম্প,পাঁচকাহনিয়া-বাঘমারা ২ ক্যাম্প ও জামালপুরের হাড়িয়াকোণা ক্যাম্প।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, উলফার প্রথম ও প্রকাশ্য ক্যাম্পটি নির্মিত হয় ২০০১ সালের শেষ দিকে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানার গজনী গ্রামের রাঙ্গাবুড়ির বাড়ির আঙ্গিনায়। এ কাজের পুরোটাই হয় রঞ্জন চৌধুরীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এরপর থেকেই গজনী সীমান্তে সশস্ত্র উলফা যোদ্ধাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। শুধু গজনীর আশেপাশেই ক্যাম্প গড়ে তোলা হয় আরো তিনটি। সেখানে ছোট বড় চারটি ক্যাম্প ও আদিবাসীদের বাড়ি-ঘরে তিন থেকে সাড়ে তিন’শ সশস্ত্র উলফা সদস্য সার্বণিক অবস্থান করতে থাকে।

ক্যাম্পগুলো পরিচালনায় দায়িত্ব পালনকারী অন্য উলফা কমান্ডাররা হচ্ছেন আলফা জাগির ওরফে বিটু, কমান্ডার জেমস ও কমান্ডার রিপন ওরফে সহিদ। এদের মধ্যে আলফা জাগির ওরফে বিটু তার স্ত্রী ও এক ছেলেসহ এখনও বড় গজনী গ্রামের বাসিন্দা খ্রিস্টর বাড়িতে বসবাস করছেন।

উলফার অন্যতম সামরিক কমান্ডার রঞ্জন চৌধুরী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহজাহান কবীর ২০ জুলাই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র-গ্রেনেডসহ অন্যান্য বিষয়ে রঞ্জন চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন। তাকে ব্যাপকভাবে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলেও ওসি মন্তব্য করেছেন।

চট্টগ্রামে ১০ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা, বগুড়ায় এক ট্রাক বিস্ফোরক আটকের ঘটনাসহ বহুল আলোচিত অনেক ঘটনার সঙ্গে উলফা’র সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে ২০০৪ সালে বগুড়ায় এক ট্রাক বিস্ফোরক আটকের ঘটনায় রঞ্জন চৌধুরী গ্রেফতার হয়েছিলেন।

রঞ্জন চৌধুরী এ মুহূর্তে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানার অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রথমে তিন দিনের রিমাণ্ডে ছিলেন। বুধবার সেখানকার আদালত তাকে আরো ৭দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন।

দুর্গম পাহাড়-বনাঞ্চলে উলফার সাংগঠনিক কাজ চালানো ও সশস্ত্র গ্রুপের ক্যাম্প বানানোর সুবিধার্থে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টির কৌশল প্রয়োগ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন রঞ্জন চৌধুরী।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র হয়ে দিনের পর দিন গোটা গারো পাহাড় এলাকা চষে বেরিয়ে রঞ্জন চৌধুরীর ব্যাপারে পাওয়া গেছে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বাংলাদেশে বেশ আগে থেকেই তার আসা যাওয়া ছিল। ১৯৯৭ সালের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়জুড়ে ১৩টি উলফা ক্যাম্প গড়ে তুলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

শেরপুর জেলার পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে বলেছেন, রঞ্জন চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর এখন তার অবস্থান ও কার্যক্রমের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। ভিন্দেশি একজন উগ্রপন্থী কমান্ডার এ জেলায় প্রায় স্থায়ীভাবে ঘাঁটি বানানো সত্তেও তার ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য শেরপুরের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সংগ্রহে নেই। থানাগুলোতে তার বিরুদ্ধে মামলার রেকর্ড পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

দৃর্ধর্ষ উলফা কমান্ডারকে শিগ্গিরই ঢাকায় সিআইডি দপ্তরে এনে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে বলে উচ্চ পর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।

মেধাবী ছাত্র থেকে জঙ্গিবাদে দীক্ষা

প্রায় ৪৫ বছরের সুঠামদেহী রঞ্জু তামাটে বর্ণের মানুষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার সঙ্গে ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আসামের ধুব্ড়ি জেলা সদরের নাগরিক রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মাসুদ রঞ্জু চৌধুরীর প্রকৃত নাম রঞ্জু বাড়ৈ। ধুব্ড়ির রাজ কলেজের মেধাবী ছাত্র রঞ্জু বাড়ৈ ১৯৮৭ সালে উলফা’র সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৯৪ সালে ভারতীয় সেনা অভিযানের মুখে তিনি প্রথমবারের মতো আসাম থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

এর আগে ১৯৮৮ সালে তাঁর সঙ্গে উলফার প্রয়াত দুই নেতা অবিনাশ অধিকারী ও দিগন্ত দাসের হাত ধরে তিনি উলফার সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে তিনি উলফার অধীনে আসামের গোয়ালপাড়া ও মেঘালয়ে তিন মাসের সামরিক প্রশিণ  নেন। তিনি এসএমজি, একে-৪৭ রাইফেল, উজি রাইফেলসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড চালানোয় পারদর্শী।

পরেশ বড়ুয়া ও অনুপ চেটিয়া কানেকশন

রঞ্জু চৌধুরী ১৯৯৫ সালে উলফা’র ধুবড়ি জেলা সম্পাদক এবং ২০০১ সাল থেকে আসামে উলফার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯৫ সালের জুনে উলফার শীর্ষনেতা পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তিনি ভুটানে অবস্থান করেন। একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর ভুটান থেকে ভারতে ফেরার পথে রঞ্জু চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। প্রায় ১১ মাস গৌহাটি কারাগারে আটক থাকার পর ’৯৬ সালের নভেম্বরে তিনি ছাড়া পান।

রঞ্জু চৌধুরী ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে সাাতের জন্য ভারত থেকে সড়কপথে কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্ত দিয়ে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। তাঁর পাসপোর্ট নেই। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও রৌমারী এলাকার বাসিন্দা সেলিম ও মিন্টু নামে উলফার অস্ত্রবাহক দলের দুই সদস্য তাঁকে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় এনে জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন মনিপুরী পাড়ার একটি বাড়িতে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। এ সময় পরেশ বড়ুয়াও সেখানে ছিলেন। তাঁকে দিকনির্দেশনা দিয়ে উলফার সদস্য মানিক কোর্চের তত্ত্বাবধানে শেরপুরে পাঠান। এরপর থেকে তিনি শেরপুরেই অবস্থান করতে থাকেন এবং সেখান থেকে আসামে যাওয়া-আসা করতেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর রঞ্জু চৌধুরী নিজেও এসব তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।

প্রতিপত্তি,বন্ধুলাভ ও বিয়ে

দুর্গম গারো পাহাড়ের বড় গজনী, বাঁকাকুড়া, মরিয়মনগর এলাকায় একটানা দীর্ঘদিন অবস্থান করার সুবাদে অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে তার বন্ধুসুলভ আচরণেরও যথেষ্ট সুনাম রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

১৯৯৮ সালে মণীন্দ্র হাগিদকের মেয়ে সাবিত্রীকে তিনি বিয়ে করেন। রঞ্জুর বিয়ের জমজমাট অনুষ্ঠানে উলফার শীর্ষনেতা পরেশ বড়ুয়া, শশধর চৌধুরী, চিত্রবন হাজারীকাসহ প্রথম সারির বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ঝিনাইগাতি থানার মরিয়মনগর এলাকায় মণীন্দ্র হাগিদকের মেয়ে সাবিত্রীকে বিয়ে করে শ্বশুরালয়েই রঞ্জু চৌধুরীর আশ্রয় জোটে। মরিয়মনগরের ভোটার তালিকাতেও তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর বড় গজনী গ্রামে নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন রঞ্জু চৌধুরী।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় গোলা-বারুদ বোঝাই ট্রাক আটকের পরপরই ঢাকা থেকে সিআইডি’র একটি বিশেষ টিম শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি থানার মরিয়মনগর গ্রামে অভিযান চালিয়ে উলফা কমান্ডার রঞ্জু চৌধুরীসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। ঢাকায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে তাদের টানা ৫ দিন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর রঞ্জুসহ ৫ জনকে শেরপুর আদালতে হাজির করা হলে তাদের জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে এ.কে-৪৭ রাইফেল বিক্রি করা নিয়েও রঞ্জুর নাম আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে আর কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

শেরপুর জেলা গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সদ্য বদলি হওয়া একজন কর্মকর্তা জানান, শেরপুরের জজকোর্ট থেকে জামিনে বের হওয়ার পর রঞ্জুকে গজনী সীমান্তের তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস ও চলাফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। নকশী বিডিআর ক্যাম্প পেরিয়ে ঝিনাইগাতি সদরের দিকে চলাফেরা করতে দেখে তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশও দেওয়া হয় থানা পুলিশকে।

স্থানীয় সূত্রগুলো আরো জানায়, উলফার জোন কমান্ডার রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মাসুদ রঞ্জু চৌধুরী নিজে ব্যবহার করেন একটি হালকা আকাশী রঙের নোয়া ব্র্যান্ডের মাইক্রো (নং-শেরপুর ব ১৪-০১২৩) এবং একটি লাল রঙের ইয়ামাহা স্কট মোটর সাইকেল (নং-ময়মনসিংহ-হ ১৩-৩১৪২)। কিন্তু গাড়ি ও  মোটর সাইকেলে ব্যবহৃত নম্বরগুলোও ভূয়া।   এ বক্তব্য কয়েকজন স্থানীয় আদিবাসী যুবকের। তারা আরো জানান, গজনীসহ আশপাশের এলাকায় উলফা সদস্যরা ৭/৮টি মাইক্রোবাস ও ২০ টিরও বেশি মোটর সাইকেল ব্যবহার করে। সবগুলোর নম্বর প্লেটই ভূয়া। একটি গাড়িরও রেজিস্ট্রেশন নেই।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।