ঢাকা: অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশের জন্য ২০১০ সালটিকে অর্জনের বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এ বছরেই বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এভারেস্ট শৃঙ্গে।
পাটের জেনোম বা জীবন রহস্য আবিষ্কার করে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি কুড়িয়েছেন বাংলাদেশি গবেষক। আর সহরাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নারী ও শিশুমৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার সাফল্যে আমরা পেয়েছি জাতিসংঘ পুরস্কার। জয় করেছি এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেট স্বর্ণপদক । সেই সঙ্গে মহিলা ক্রিকেটের রৌপ্যপদক।
এক: মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয়
২৩ মে, রোববার। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের শিখরে বাঙালি হিসেবে প্রথম পা রাখেন মুসা ইব্রাহীম। ৩০ বছর বয়সী এই তরুণ ২০ এপ্রিল এভারেস্টের তিব্বতের অংশ দিয়ে অভিযান শুরু করেন। বাংলাদেশের নর্থ আলপাইন ক্লাবের সদস্য মুসা ইব্রাহীমের এই সাফল্যের সংবাদ দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। কারণ তিনিই নিজের হাতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওড়ান বাংলাদেশের লাল-সবুজ-পতাকা। এর আগে ২০০২ সালে অন্নপূর্ণা ট্রেইলে অভিযানের মধ্য দিয়ে মুসা স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যান। সে সময় তিনি ১২ হাজার ৪৬৪ ফুট ওঠেন।
দুই. শেখ হাসিনার জাতিসংঘ পদক গ্রহণ
এমডিজি অর্জনে সাফল্য ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের বিশেষ কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘ পদক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পদক গ্রহণ করেন। নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া হোটেলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে ৮ দফা এমডিজি নির্ধারণের দশ বছর পর এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তিন: ক্রিকেটে সাফল্য দেখলাম
চীনে অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অন্তভর্’ক্ত খেলা ক্রিকেটে শেষ হাসি হাসি হাসে বাংলাদেশ। এ যেন ‘ভিনি ভিদি,ভিসি’-- ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। এশিয়ান গেমসের প্রথম আসরেই কিস্তি মাত-- স্বর্ণপদক জয়। মহিলা ক্রিকেট দলও কম যায় না! তারা বাগিয়ে নেয় রৌপ্যপদক।
আর অক্টোবরে মাইক্রোম্যাক্স ওডিআই সিরিজে ক্রিকেটের কুলীন দল নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ করে বাংলাদেশ। ৪-০ ম্যাচে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে এই হোয়াইট ওয়াশ করে গোটা দুনিয়ার নজর কাড়ে। সিরিজকে কেন্দ্র করে আবারো আনন্দের জোয়ারে ভেসে উঠে ক্রিকেটপ্রেমীরা।
এরপর আসে জিম্বাবুয়ে। প্রথম ম্যাচে হোঁচট খেলেও পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের সব ক’টি ম্যাচে জিতে যোগ্যতর দল হিসেবে সিরিজ শিরোপা ঘরে তোলে মাশরাফি-সাকিব বাহিনী।
চার: বাঙালি বিজ্ঞানির কৃত্রিম কিডনি উদ্ভাবন
বছরের শেষ দিকে কৃত্রিম কিডনি উদ্ভাবন/আবিষ্কার করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক শুভ রায়সহ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা এমন কিডনি তৈরি করেন, যা শুধু রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনই করে না, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন ডি সংশ্লেষ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায়ও সাহায্য করে। শুভ রায় ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ডা. অশোক নাথ রায় ও মা রত্না রায়।
পাঁচ: পাটের জেনোম বা জন্মরহস্য আবিষ্কার
এবছর সোনালী আঁশ পাটের জন্ম রহস্য (জিনোম সিকুয়েন্স) উদ্ভাবন করেন গবেষক ড. মাকছুদ আলম ও তাঁর সহযোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ। ১৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সুখবর জানান। জন্ম রহস্য আবিষ্কারের ফলে পাটের আঁশকে উন্নত করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরূপ আবহাওয়া মোকাবেলায় সক্ষম বীজ উদ্ভাবন সম্ভব হবে। এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া ছাড়া একমাত্র বাংলাদেশই উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে এ ধরণের একটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।
ছয়: ৪৫০১টি তথ্যকেন্দ্র ও তথ্য-বাতায়ন
১১ নভেম্বর দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে একযোগে চালু করা হয় তথ্য সেবাকেন্দ্র। এই সব সেবাকেন্দ্রগুলো থেকে সুলভে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য ও সেবা দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারি ফর্ম, সরকারি সার্কুলার, বিধি, বিজ্ঞপ্তি, বিভিন্ন ডকুমেন্ট, জন্ম নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ তথ্য, স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসার এমপিওভূক্তির তথ্য এবং ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডধারীদের তথ্য ভান্ডার। এছাড়া বছরের শুরুর দিকে দেশের ৬৪ জেলার তথ্যাবলী নিয়ে একযোগে চালু করা হয় ‘জেলা তথ্য-বাতায়ন। ’ জেলা তথ্য বাতায়নে ওই সকল জেলার প্রধান প্রধান উন্নয়ন পদক্ষেপসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী রয়েছে।
সাত: আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশ
বছরের শেষ দিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আইটি গবেষণানির্ভর প্রতিষ্ঠান ‘গার্টনার’ তাদের সর্বশেষ সমীক্ষা প্রকাশ করে। এই সমীক্ষায় বিশ্বের ৩০টি আইটিনির্ভর আউটসোর্সিং দেশের তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশ। যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য এটি একটি বড় অর্জন। ভবিষ্যতে এ স্বীকৃতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
আট: প্রত্যাশিত শিক্ষানীতি
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে একটি আলোচিত বিষয়। বছরের শেষ সময়ে নতুন শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে অনুমোদন পেয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে নীতিতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার বিধান রয়েছে। যার অনেকাংশই ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে।
নয়. মহাকাশে বসবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
দেশের তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে মহাকাশে উপগ্রহ স্থাপন করবে বাংলাদেশ। এর নাম হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন এ উপগ্রহ দেশের সম্প্রচারভিত্তিক প্রযুক্তিকে দ্রুতগতিসম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
দশ: সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি
দীর্ঘদিন ধরেই জাহাজ তৈরি করছে বাংলাদেশ। তবে ২০১০ সালেই প্রথমবারের মত গভীর সমুদ্রে সব আবহাওয়ায় চলাচল উপযোগী জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম হই আমরা। এই সময়ে ‘গ্রোনা অ্যামারসাম` ও `গ্রোনা বিয়েস্সাম` নামের দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ একটি জার্মান কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া ডেনমার্কের কাছেও এরকম গভীর সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে বাংলাদেশের এক নির্মাতা কোম্পানি। এদের একটির নাম ‘স্টেলা মুন’ ও অন্যটির নাম ‘স্টেলা মারিস’। এছাড়া আরো বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশ থেকে জাহাজ কেনায় আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০