ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

‘বাঙালি লেখক, বাংলায় ঠাঁই নেই’

মাহমুদ মেনন, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১১
‘বাঙালি লেখক, বাংলায় ঠাঁই নেই’

ঢাকা: যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক, প্রগতিশীলতার কথা বলা হোক, দেশ পড়ে রয়েছে একই অন্ধকারে। নারীবাদী প্রতিবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফতোয়ার প্রসঙ্গটি উঠে এলে একথা বলেন তিনি।



শরিয়তপুরে ফতোয়াবাজের হাতে নিহত কিশোরী হেনাকে নিয়েই কথা হচ্ছিলো তসলিমার সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার সকালে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে আলাপ হয় টেলিফোনে। বেলজিয়ামে অবস্থান করছেন  তিনি। এর আগে বুধবার বেলজিয়ামের লুভাঁ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি নেন অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি। ল্যাটিন ভাষায় যাকে বলে ‘ডক্টরিস অনরিস কোসা’।

লুভাঁ প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের জ্ঞানী-গুনিদের অনারারি ডক্টরেট দেওয়ার রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির দীর্ঘ ঐতিহ্য। এবারে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে এ ডিগ্রি পেয়েছেন আরও দুই জন। এরা হচ্ছেন ব্রিটিশ অধ্যাপক টিম জ্যাকসন ও মার্কিন অধ্যাপক জে বি শ্র্যাম।

এই সম্মাননা পেয়ে খুবই আনন্দিত বলে বাংলানিউজকে জানালেন প্রতিবাদী এ লেখক। তিনি বললেন, ‘আমার আদর্শ, আমরা ভাবনা, আর লেখালেখিকে পুরস্কৃত করতেই এ ডিগ্রি দিয়েছে লুঁভা। ’

পাশাপাশি কন্ঠে তার খেদও ঝরে পড়লো: ‘যে লেখালেখি ও ভাবনার প্রকাশের জন্য দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছি ঠিক একই লেখালেখির জন্য বিশ্বের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্মানসূচক ডিগ্রি দিচ্ছে, এটাই বিস্ময়ের। ’

ফতোয়াবাজদের র্দোরায় হেনার মৃত্যুতে সুদুর ব্রাসেলসের হোটেলকক্ষে বসেও ব্যথিত কণ্ঠে তসলিমা নাসরিন বললেন, ‘এরকম তো ঘটেই চলেছে। ফতোয়া দিয়েই আমাকেও দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যারা ফতোয়া দিয়েছে তাদের আজও কিছু হয়নি। আর তাদের ছত্রছায়ায় খুদে ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। তারই অনিবার্য শিকার কিশোরী হেনা। ’

তবে  হেনার ঘটনাটি এমন অনেক ঘটনারই একটি প্রকাশিত অংশমাত্র বলে উল্লেখ করে প্রতিবাদী এই নারীবাদী লেখক বলেন, ‘একা প্রতিবাদ করলে কোনো সুফল আসবে না। সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করতে হবে। ’
 
তিনি বলেন, ‘আমি একা প্রতিবাদ করেছিলাম। মনে করেছিলাম আমার প্রতিবাদে কাজ হবে। কিন্তু হয়নি। বরং আমাকেই দেশছাড়া করা হয়েছে। ’

যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে তসলিমা নাসরিন বলেন, ‘এখনো এ ধরনের ঘটনা যতগুলো ঘটে তার সামান্যই ক’টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। একটি দুটি ঘটনার ফলাও করে প্রকাশ করলেই এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এমন হাজারো যৌন হয়রানির কথা, ধর্ষণের কথা থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, থেকে যায় অজানা।
 
তিনি বলেন, ‘আদালত যৌন হয়রানিকে ‘ইভ টিজিং’-এর মতো রোমান্টিক শব্দের খোলস থেকে বের করে আনার যে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে আমি স্বাগত জানাই। ’

তসলিমা নাসরিন বলেন, আমি বহু বছর ধরেই এই শব্দটির আড়ালে যৌন হয়রানির সত্যিকারের ভয়াবহতা ঢাকা পড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে আসছি।

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে একুশের বইমেলা শুরু হওয়ার প্রসঙ্গটি তুলতেই আবেগে আপ্লুত হলেন তসলিমা নাসরিন। বললেন, ‘বইমেলা ছিলো সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। কিন্তু এখন বইমেলায় আমার কোনো বই বের হয় না। বাংলাদেশের কোনো প্রকাশকই আমার লেখা বই বের করতে চান না। জানি না কী কারণ? হয়তো তারা ভয়ই পান। ’ কন্ঠে হতাশা ও ক্ষোভ  ঝরে পড়ে তার।

সেই সঙ্গে তসলিমা জানালেন, তার অনেক বই এখন পাইরেটেড হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। কারা করছেন, কিভাবে করছেন তার কোনো কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য তাকে কোনো রয়্যালটিও দেওয়া হচ্ছে না।

তসলিমা নাসরিন বলেন, শেষ আশ্রয় হিসেবে কলকাতার বইমেলাকে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাও বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমার জন্য দুই বাংলার বই মেলাই নিষিদ্ধ হলো।

‘কী অবাক বাঙালি লেখকের বাংলায় ঠাঁই নেই। ’

তিনি বলেন, ‘আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমি মনে করি এ জন্য বাঙালির লজ্জা হওয়া উচিত। ’

তাকে প্রশ্ন করা হয়:‘নতুন কি লিখছেন?’
--‘এ সময়ে আত্মজীবনীর ৭ম খণ্ড ও একটি কবিতার বই লিখছি। তবে দুঃখ লাগে যাদের জন্য লিখছি তাদের কেউ এসব লেখা পড়তে পারবে না’--সখেদে জানালেন তসলিমা।

যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান তসলিমা। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।

দেশে ফেরার কোন চেষ্টাই সফল হচ্ছে না উল্লেখ করে তসলিমা নাসরিন বলেন, ‘আমাকে আমার বাবার মৃত্যুর সময়ও দেশে যেতে দেওয়া হয়নি। ’

এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হাল আর কি ধরবো?’ ১৭ বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই অপমাণিত হয়ে ফিরতে হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আমার পাসপোর্ট যাতে নবায়ন করা না হয়। দূতাবাসগুলো সে নির্দেশই পালন করে যাচ্ছে।
 
বেলজিয়ামে আরো ২/৩ দিন থেকে দিল্লি যাবেন এমনটাই জানালেন তসলিমা নাসরিন।

বাংলাদেশ সময় ১৮১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।