ঢাকা: অবসরে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আগামী ১৭ মে তার শেষ কর্মদিবস।
এসবের মধ্যে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বৈধতা, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসের অপসারণ ও ফতোয়া নিষিদ্ধকরণ প্রসঙ্গ।
অবকাশকালীন ছুটি শেষে আগামী ২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট খোলার পর মাত্র ১৭ কর্মদিবস থাকছে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের হাতে।
এর অধিকাংশ মামলা নিয়েই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিমণ্ডল ছাপিয়ে বহির্বিশ্বেও আলোচনা চলছে। এর মধ্যে গ্রামীণব্যাংকে ড.ইউনুসের পদ নিয়ে মামলাটি সারা দুনিয়ার নজর কেড়েছে।
আপিল বিভাগের কোন বিচারপতি যেসব মামলার শুনানি গ্রহণ করেন অবসরে যাওয়ার আগে তিনিই সেসব মামলায় রায় দেন, এমনটাই রীতি। তবে এক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।
কিন্তু কোন মামলার শুনানিকালে আপিল বিভাগ থেকে কোনো বিচারপতি অবসরে গেলে বা কোনো নতুন বিচারপতি এলে সেক্ষেত্রে পুনরায় শুনানি গ্রহণ করতে হবে।
এসবের বিবেচনায়, শুনানির চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা বিষয়গুলোতে প্রধান বিচারপতির রায় দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘যদি প্রধান বিচারপতি এসব মামলার শুনানি গ্রহণ শেষ করতে পারেন তবে রায় দিয়ে যাবেন নতুবা তিনি অবসরে যাওয়ার পর এসব বিষয়ে পুনরায় শুনানি করতে হবে। ’
কোনো মামলার শুনানি গ্রহণ করলে তার রায় দিয়ে যাওয়ার কোন আইনি বাধ্যবাধকতা আছে কিনা এপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিক সেভাবে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই তবে সাধারণত শুনানি গ্রহণ করলে অবসরে যাওয়ার আগে বিচারপতিরা তার রায় দেন। ’
তিনি আরো জানান, তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রশ্নে আপিলের শুনানি শেষ, আদালত খুললে যে কোন দিন রায় দিতে পারেন। এছাড়া আদালত খোলার পর ড. ইউনূস ইস্যুতে শুনানি হবে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আগামী ১৭ মে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সর্বশেষ কর্মদিবস। এরপরেই তিনি অবসরে যাবেন।
দেশে তত্ত্ববধায়ক সরকার সংবিধানসম্মত কিনা তা নির্ধারণের দয়িত্ব এখন সুপ্রিম কোর্টের। দেশে এ ব্যবস্থা থাকবে কিনা তা অনেকটা নির্ভর করছে আপিল বিভাগের রায়ের ওপর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
গত ৬ এপ্রিল এ বিষয়ক শুনানি গ্রহণ শেষে আপিল বিভাগ বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছে।
উল্লেখ্য, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ওই বছরের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ এ রিট খারিজ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।
এরপর ২০০৫ সালে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ। দীর্ঘ বিরতির পর গত ১ মার্চ শুনানি শুরু হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন।
এদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরা হলেন-ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যার্টনি জেনারেল মাহামুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, ব্যাব্যিারিস্টার রফিক-উল-হক ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে জমা দিয়েছেন।
শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন।
এছাড়া অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।
গ্রামীণব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মূহাম্মদ ইউনূসের থাকার প্রশ্নে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির নয়জন পরিচালকের করা আপিল অনুমতির আবেদনটি (লিভ টু আপিল) শুনানির জন্য আপিল বিভাগে আছে।
এছাড়া একই বিষয়ে ড. ইউনূসের আপিল অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) খারিজ করে দেওয়া আপিল বিভাগের আদেশের প্রত্যাহার চেয়ে করা (রিকল আপিল) আবেদনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
গত ৬ এপ্রিল, সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর শুনানির দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। ২৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের ছুটি শেষ হবে। সেক্ষেত্রে ২ মে শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
উল্লেখ্য ২ মার্চ গ্রামীণব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতির আদেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩ মার্চ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণব্যাংকের নির্বাচিত নয় জন পরিচালক এর বিরুদ্ধে দুটি রিট আবেদন করেন। ৮ মার্চ হাইকোর্ট দু’টি রিটই খারিজ করে দেন।
এর বিরুদ্ধে ৩ এপ্রিল নিয়মিত আপিলের অনুমতি চেয়ে দুটি আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়।
এছাড়া রয়েছে, ২০০১ সালে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি চলছে আপিল বিভাগে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর মুফতি মো. তৈয়ব ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল করেন। দীর্ঘদিন পর এ বছরের ১ মার্চ আপিলের শুনানি শুরু হয়।
গত ১০ মার্চ সর্বশেষ শুনানিতে ফতোয়া বিষয়ে দেশের পাঁচজন আলেমের মতামত জানতে চেয়েছেন আপিল বিভাগ। তাদেরকে লিখিতভাবে অথবা ওই দিন হাজির হয়ে মতামত জানাতে বলা হয়।
সংশিষ্ট পাঁচ আলেমের নাম আপিল বিভাগে জমা দিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন পাঁচজন আলেম নির্বাচনের কাজ এরই মধ্যে শেষ করেছে।
এছাড়া প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি গৌরগোপাল সাহার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতার ইস্যু, যমুনা টিভি ইস্যুসহ আরও বেশ কিছু বিষয় আপিল বিভাগের শুনানির তালিকায় রয়েছে ।
উল্লেখ্য, গতবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এবিএম খায়রুল হক।
এরআগে ২৬ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারক এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।
খায়রুল হক ১৯৯৮ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ২০০০ সালের ২৭ এপ্রিল। আর আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১১