চট্টগ্রাম: হুমকির মুখে পড়েছে বঙ্গোপসাগরের ফিশিং গ্রাউন্ড। দেশের মূল ভূভাগের চেয়েও আয়তনে বড় (১ লক্ষ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার) এই ফিশিং গ্রাউন্ডে নির্বিচারে চলছে ইলিশের জাটকা, সাদা মা মাছ ও মাছের পোনা শিকার।
বিশাল এই জলসীমার চারটি (সোয়াস অব নো গ্রাউন্ড, সাউথ অব সাউথ প্যাসেজ, সাউথ প্যাসেজ ও মিডল গ্রাউন্ড) ফিশিং জোন থেকে দেশের ২৫ শতাংশ প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহ হচ্ছে প্রতিদিন। বছরে ৬০ হাজার মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি করে আসছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও।
কিন্তু সরকার নির্ধারিত মাপের চেয়েও ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে নির্বিচারে পোনা মাছ শিকারের কারণে এ অঞ্চল থাই সাগরের মতো মৎস্য শূন্য হয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের মুখে।
এ প্রসঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাফর আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ মৎস্যশিকারে চলমান অনিয়ম চলতে থাকলে বঙ্গোপসাগর মাছশূন্য হয়ে থাইসাগরের ভাগ্য বরণ করতে পারে। ’
এ আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেতে বঙ্গোপসাগরের তটরেখা থেকে মহিসোপানের দিকে ১০ মিটার গভীরতা বা তটরেখা খেকে পাঁচ (৫) কিলোমিটার (যে স্থানে যেটি আগে আসে) দূরত্ব পর্যন্ত জলসীমাকে নার্সারী এলাকা বিবেচনায় নো ফিশিং জোন ঘোষণা করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাফর আহমেদ বলেন, ‘এই নো ফিশিং জোনে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন চিংড়ি, মৎস্য ও অন্যান্য জলজ প্রজাতির যে কোন ধরনের লার্ভি, রেণু, পোনা, চিংড়ি মাছসহ সবরকম প্রজাতি আহরণ-নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেই এই অফুরান মৎস্য সম্পদ রক্ষা সম্ভব হবে। ’
এদিকে অপর্যাপ্ত জনবল ও টহল বোট না থাকার অজুহাত দেখিয়ে মৎস্য শিকার যথাযথভাবে মনিটর করছে না সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর।
সংর্শ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত মাপ অনুযায়ী মৎস্য ট্রলারের জালের (সাদা মাছ) শেষ প্রান্তে সর্বনিম্ন ৬০ মিমি, চিংড়ি ট্রলারের জালের শেষ প্রান্তে সর্বনিম্ন ৪৫ মিমি, বড় ভাসান জালের (লাক্কা জালের) শেষে ২০০ মি মি, ভাসান জালের (ইলিশ জাল) শেষে ১০০ মিমি ও সামুদ্রিক বিহুন্দী জালের শেষ প্রান্তে ৪৫ মিমি ফাঁস থাকার কথা।
তবে বাস্তবে সরকার নির্ধারিত জালের এই ফাঁস কোন মৎস্য ট্রলারই মানছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ট্রলার মালিকরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দেখানোর জন্য ট্রলারের উপরে নির্ধারিত ফাঁসের কিছু জাল রাখলেও গোপনে তারা অনেক ছোট ফাঁসের জাল রাখে। সাগরে ট্রলিংকালে এসব কাজে লাগায়।
ছোট ফাঁসের এসব জাল দিয়ে জাটকা থেকে বিভিন্ন ধরণের সাদা মাছের পোনা ধরা হয়।
মৎস্যশিকারী ট্রলারে কর্মরত কয়েক জন স্কিপারের সঙ্গে কথা বলে জাটকা ও পোনা মাছ আহরণের নানা তথ্য পাওয়া যায়। তবে তারা বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তারা তথ্য দিয়ে বলেন, ‘আগে আমরা মা মাছ শিকার করে এলেও কখনও জাটকা ও সাদা মাছের পোনা ধরতাম না। জালে এসব মাছ ধরা পড়লেও ট্রাস ফিস হিসেবে সাগরে ফেলে দিতাম। কিন্তু এখন মালিকদের নির্দেশে এসব মাছ ধরতে হয়। ’
তারা বলেন, ‘এখন বাজারে জাটকার কদর যেমন বেড়েছে তেমনি ট্রাস ফিসও বিক্রি হয়। ’
পোনা জাতীয় খাওয়ার অযোগ্য মাছ টন হিসেবে পোল্ট্রি ফিড তৈরির জন্য বিক্রি হয় বলেও জানান তারা।
মৎস্য শিকারি জাহাজের এক স্কিপার বাংলানিউজকে বলেন, মার্চের পর থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধরা পড়া অধিকাংশ মাছ ডিমওয়ালা। ’
প্রজনন মৌসুমে কোহিনূর ও সুন্দরবন গ্রাউন্ডে মাছ শিকারে দেশের মৎস্যসম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হয় বলে স্বীকার করলেও ট্রলার মালিকদের নির্দেশের কারণে তারা অসহায় বলে দাবি করেন ওই মৎস্য শিকারি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের পরিদর্শন টিমের সদস্যদের যেকোনো ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে জালসহ অন্যান্য সামগ্রী ও সাগর থেকে ফেরার পর ধৃত মাছ পরীক্ষা নিরীক্ষার নিয়ম রয়েছে।
কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরে জনবল ও টহল বোট না থাকার অজুহাত দেখিয়ে এ নিয়ম মানা হয় না।
সূত্রমতে, বর্তমানে সাগরে শিকাররত ট্রলারগুলোতে তল্লাশি চালালে টনে টনে জাটকা, পোনা ও মা মাছ যেমন পাওয়া যাবে তেমনি বিপুল পরিমাণ ছোট ফাঁসের জাল উদ্ধারও সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. মোহাম্মদ শরীফ জনবল ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে গভীর সাগরে অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেন।
তবে মৎস্যসম্পদ রক্ষায় গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অবৈধ আহরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বাংলানিউজকে জানান, বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এরমধ্যে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ থেকে ৭ প্রজাতির লবস্টার ও ৩৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শশা পাওয়া যায়।
এছাড়া ৩ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১২ প্রজাতির কাঁকড়াও ধরা হয় বঙ্গোপসাগর থেকে।
এসবের মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ, পোয়া, রূপচান্দা, দাতিনা, ছুরি, চউখ্যা, কাঁটা মাছ, লাক্ষা, কামিলা, রূপবান, রাঙা চউখ্যা, লাল মাছ, মাইট্টা, লইট্টা, আইল্যা, বাগদা, চাগা, বাগাচামা, হরিণা, লইল্যা, নুইল্যা, নূয়া চাই, হাঙ্গর, কাঁকড়া, স্কুইড ইত্যাদি আহরিত হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৬ কোটি জনসংখ্যার এদেশে ২৫ ভাগ প্রাণিজ প্রোটিন আসে বঙ্গোপসাগরের মাছ থেকে।
উপরন্তু প্রতিবছর ৬০ হাজার মেট্রিক টন মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দক্ষিণে টেকনাফ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত সূদীর্ঘ ৭১০ কিলোমিটার ব্যাপী উপকূলীয় তটরেখা ও বেসলাইন (১০ ফ্যাদম গভীরতা পর্যন্ত) থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা। এর আয়তন ১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের মূল ভূভাগের আয়তনের চেয়েও বেশী।
বিশাল এই জলসীমাকে চারটি ফিশিং জোনে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- সোয়াস অব নো গ্রাউন্ড, সাউথ অব সাউথ প্যাসেজ, সাউথ প্যাসেজ ও মিডল গ্রাউন্ড।
এখানে ১৭০টি আধুনিক মৎস্যশিকারী ট্রলার মৎস্য শিকার করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১১