ঢাকার গাছ মরার কারণ ও এ সমস্যার সমাধান কিভাবে হতে পারে এ ব্যপারে উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জিন বিজ্ঞানী,অণুজীববিজ্ঞানী, নিসর্গবিদ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন মত দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম বলেন, মূল কথা হলো দূষিত ঢাকা কোন উদ্ভিদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনছে না।
ঢাকা কংক্রিটে আচ্ছাদিত। ফলে বৃষ্টির পানি নিচের দিকে যেতে পারে না । এতে করে কৃত্রিম খরার সৃষ্টি হয় ও গাছ মারা যায়।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গাছের শিকড়ের নাগালের বাইরে থাকে ফলে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে গাছ মরে যাচ্ছে ।
যেসব গাছ ভূগর্ভস্থ পানি পায় সেই পানিও আবার আর্সেনিক, কপার, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, কীটনাশক পদার্থ ইত্যাদি দ্বারা দূষিত। এগুলো শোষন করার ফলে উদ্ভিদ দেহের অনেক শরীরতাত্ত্বিক বা বিপাকীয় পরিবর্তন ঘটে। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্যরস গ্রহণ করতে না পেরে গাছের মৃত্যু ঘটে। সর্বোপরি গাছের আশপাশের সার্বিক পরিবেশ বিনষ্ট হওয়া গাছের মড়কের প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করেন।
প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি শিল্পবর্জ্য দূষণজনিত সংকট মোকাবেলা করছে। এখানকার গাছপালা, কৃষি, মৎস্যসম্পদ তথা পুরো জীববৈচিত্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ’
তিনি বলেন, ‘মানুষ বসবাস করাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে গাছতো ভালো থাকবেই না।
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার বাতাস, পানি ও মাটি দূষিত হয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাট সব কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ঢুকতে পারছে না মাটিতে। অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে মাটিতে। রাস্তার ফুটপাথে যে দুই একটা গাছ আছে সেগুলোর চারপাশ ইট সিমেন্টে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যা গাছের জন্য ক্ষতিকর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের কাছে কোন জীবাণুর আক্রমণে গাছ মারা যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, পানি ও মাটির ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক,ভাইরাস ইত্যাদিরও আক্রমণ ঘটে। বিভিন্ন বর্জ্য থেকে সীসা,আর্সেনিক, কপার, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, বোরন, সালফার প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ অধিক পরিমাণে গাছের সংস্পর্র্শে আসে। গাছ তা গ্রহণ করতে পারে না । কিন্ত এসবের প্রভাবে ক্রমান্বয়ে গাছের জীবনীশক্তি লোপ পায়।
কীটনাশক পদার্থ, প্লাস্টিক-দ্রব্য,কঠিন পদার্থ মাটির অণুজীব ধ্বংস করে ফেলে। এভাবে মাটি তার উর্বরতা হারায়, গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্যেও যোগান দিতে ব্যর্থ হয় ফলেও গাছ মারা যেতে পারে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা )‘র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘মানুষের অসচেতনতা, মানুষের অরিণামদর্শী লোভ আর মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে গাছ মরে যাচ্ছে । একটি গাছ কাটার পর এটির জায়গায় আর গাছ লাগানো হচ্ছে না। শুধু দালান উঠছে, মিনার উঠছে, কংক্রিটের দখলে চলে যাচ্ছে আকাশ। গাছের জায়গা কই?’
জীণগত সমস্যার চেয়ে পরিবেশ ও গাছের খাদ্য সমস্যার কারণেই মূলত ঢাকার গাছ মারা যাচ্ছে বলে মনে করেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জেসমিন।
পরিবেশবিজ্ঞানী কাজী জাকের হোসেনের মতে, ‘বিদেশি গাছের প্রভাবেও দেশি গাছ মরে যাচ্ছে । বিদেশি গাছের পাশে দেশি গাছ বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। কারণ বিদেশি গাছের মূল থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয় যা দেশি গাছের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এদেশের পশু-পাখি বিদেশি গাছের ফুল-ফল গ্রহণ করে না। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ’
তিনি বলেন,‘দালানকোঠার ভিড়ে গাছ তার খাদ্য উৎপাদনের যে প্রস্বেদন প্রক্রিয়া তা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারছে না। বাতাস, পানি, আলোর প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের যে খাদ্য উৎপাদন তা হচ্ছে না ফলে খাদ্য ছাড়া গাছ আর কতদিন আর বাঁচবে!’
ঢাকায় গাছ মারা যাওয়ার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি বলে তারা মনে করেন । গাছ নিয়ে সরকারেরর কোনও বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে না। তাই এর সমাধানও বের হয়ে আসছে না। ঢাকার পরিবেশ সারা দেশের থেকে ভিন্ন বলে ঢাকার গাছপালা জন্য আলাদাভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন জরুরী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এ ব্যাপারে দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘গাছের মড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করণে সমন্বিত গবেষণা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। গাছের চারপাশের মাটি একটু নরম থাকা, কমপক্ষে একমিটার দূরত্বে পাকা করা, নিয়মিত পানির ব্যবস্থা থাকা দরকার। গাছের চারপাশে কমপক্ষে এক মিটার জায়গা রাখা উচিৎ। ’
তিনি বলেন,‘ মোটকথা আমাদেও নিজেদের স্বার্থে, আমাদের ঁেবচে থাকার জন্য গাছকে বাঁচাতে হবে। গাছের স্বাভাবিক প্রক্রিযাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ’ এজন্য সবার মানসিকতার পরিবর্তনের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম বলেন, বায়বীয় পরিবেশে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং বৃষ্টি ও পানির সঙ্গে মিশে মাটির অম্লতা বৃদ্ধি পেয়ে গাছ মারা যায়। তাই রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে হবে । এজন্য রাসায়নিক ও শিল্পকারখানা ঢাকার বাইরে সরাতে হবে।
তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা বাড়াতে হবে যাতে খরা মৌসুমে গাছের শিকড়ের নাগালে পানি থাকে । সকল নদীনালা দূষণমুক্ত রাখতে হবে যাতে দূষিত পানি চুইয়ে ভূগর্ভস্থ পানিতে না মিশে যায়। সার্বিক সতর্কতা ও পরিচর্যায় গাছের মড়ক রোধ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ সময়:২১৪০ঘণ্টা,০৯ মে, ২০১১