ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

নগরীর বিপন্ন বৃক্ষরাজি -৩

হারিয়ে যাচ্ছে দুর্লভ গাছ

মনোয়ারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৮ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১১
হারিয়ে যাচ্ছে দুর্লভ গাছ

গাছের শহর ঢাকা এক সময় ছিল বিশাল মহীরূহছায়াঘন, বিচিত্র জাতের বৃক্ষের সমাহার ঢাকাকে দিয়েছিল বিরল শোভা আর সৌন্দর্য। কিন্তু এখন সে রূপ আর বৈচিত্র উধাও।

দশকের পর দশক ধরে বৃক্ষ উজারের মিছিলে  ঢাকা তার আগের শ্যামল রূপশোভা হারিয়ে ফেলেছে। আর এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক দুর্লভ গাছ। যেসব দুর্লভ গাছ এখনো কোনো মতে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও নগরবাসী ও কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা, অপরিণামদর্শিতা, লোভ আর নগর পরিকল্পকদের ভুলে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অযতœ আর অবহেলাই এসব দুর্লভ বৃক্ষের ললাটলিখন।

প্রতিবছরই এসব প্রাচীন ও দুর্লভ গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে জানালেন নিসগর্বিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ।

দ্বীজেন শর্মা ছাড়াও এমিরেটাস অধ্যাপক ড. কাজী জাকের হোসেন, নিসর্গবিদ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল আজীজ, একই বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)‘র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সাথে কথা বলে ঢাকা শহরে বেশকিছু দুর্লভ গাছের তথ্য পাওয়া গেছে।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, নগরীর পুরনো গাছের অবস্থান ও বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে মূলত ঐতিহাসিকদের মত মেনে। ১৮২৫-১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে রমনায় রোপিত বিভিন্ন প্রজাতির গাছই এখন নগরীর পুরনো ও দুর্লভ গাছ। সেগুলো দিয়ে করা যেতে পারে জাদুঘর। অনেক দেশেই তা আছে। `

তিনি বলেন, ‘নগরীর পুরনো গাছ সংরক্ষণ প্রসঙ্গে তাঁর `বৃক্ষ তুমিঃ আদিপ্রাণ` নিবন্ধে মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকায়, যেসব পুরনো বৃক্ষ আছে যা `ল্যান্ডমার্ক` হিসেবে বিবেচিত সেগুলোর সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে সংরক্ষিত ঘোষণা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।   কোনও সরকারই আজ পর্যন্ত সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। ‘

রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, গণভবন ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর বাগানে এখনো টিকে আছে বেশ কিছু দুর্লভ গাছ।

একটি শতবর্ষী মহুয়া আছে শহরে। অবস্থান মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ও কলেজে। এখানে আছে বেশ কিছু বয়সী শিরীষ, দাঁড়িয়ে আছে আওরঙ্গজেব রোডের কোল ঘেঁষে।

পাখিফুলের দেখা মেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে ও শিশু একাডেমীর বাগানে একটি করে।

কনকচাঁপা ফুলের মাত্র তিনটি গাছ এখন পর্যন্ত টিকে আছে এই শহরে। গাছ তিনটি আছে বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক ও শিশু একাডেমীর বাগানে একটি করে।

বনপারুলের দেখা বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর বাগান ছাড়া আর কোথাও পওয়া যায়না।

পাদাউক গাছের দেখা মেলে হেয়ার রোডে কয়েকটি।

দুই-তিনটি পীত পাটনা গাছ আছে রমনা পার্কে।

টিএসসি, রমনা পার্ক এবং বঙ্গভবনের প্রাচীরঘেঁষে দিলকুশায় কয়েকটি বুদ্ধ নারকেল গাছ আছে।


কয়েকটি আকাশনিম বা হিমঝুরি গাছের মধ্যে ঢাবি বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের প্রবেশপথে, খ্রিস্টান কবরস্থানে এবং শিশু একাডেমীর বাগানে কয়েকটি দেখা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের সামনে সবচেয়ে বয়সী সিলভার ওক গাছের অবস্থান।

মাধবীলতার দেখা মিলবে রমনা পার্ক, শিশু একাডেমী, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও বলধা গার্ডেনে ।

কানাইডিঙ্গা নামের এক বিরল গাছের অবস্থান ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে, ঢাবি বোটানিক্যাল গার্ডেনে এবং মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ-উদ্যানে।

মৎস্যভবন থেকে রমনা থানা পর্যন্ত সড়কের ফুটপাতে আছে কয়েকটি তেলসুর।

বেইলি রোডের ক্রসিংয়ে একটি খইয়া বাবলা আছে।

মাত্র তিনটি জহুরিচাঁপা গাছ আছে রমনা ও বলধা গার্ডেনে।

ক্রিমফ্রুট প্রজাতির মাত্র ২টি গাছ আছে বলধা ও রমনায় একটি করে।

গাছটি রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনার পাশের ব¬াকবি নামেমাত্র একটিমাত্র গাছ ঢাকায় আছে ।

ধানমন্ডি ৩/এ রোডে একটি এবং বলধা গার্ডেনে একটি করে ট্যাবেব্যুইয়া গাছের দেখা পাওয়া যায়।

রমনা ও ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একটি করে দুটি বাওবাব গাছ আছে।

ঢাবি উপ-উপচার্যের বাসার সামনে পৃথিবীর সর্বশেষ প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া তালিপামের চারা রয়েছে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ৩০৪ বর্গকিলোমিটার। এই আয়তনের ঠিক কত ভাগ গাছ আছে তার কোনো হিসাব নেই বনবিভাগ বা সিটি করপোরেশনে।

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেশ কিছু দেশি-বিদেশি বিরল প্রজাতির গাছের দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলো অ্যানথোনিয়া, আগর, রেড ফ্রুট, পুনর্নভা, আকন্দ, ওল্ডম্যান ক্যাকটাস, কর্পূর, খরগোশ ফার্ন, তমাল, ডামবিয়া, ভূজ্জপত্র, মাধবী, কানাইডিঙ্গা, ট্যাবেব্যুয়া, কালোকেশি, অনন-মূল, সাদা রঙ্গন, বড় চম্পা, কারিলিফ, ছোট মুসান্ডা, রামবুতাম, ক্যান্ডল গাছ প্রভৃতি।

বলধা গার্ডেনে ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ অশোক, প্যাপিরাস, চামেলি, হাপারমালি, হংসলতা, আফ্রিকান টিউলিপ, লতা গন্ধরাজ, কনকচাঁপা, জহুরিচাঁপা, ক্রিমফ্রুট, কুরচি, মাধবী, হলুদ, নীল, লাল ও সাদা জাতের শাপলা, বিরল প্রজাতির ক্যাকটাস ও অর্কিড, ভূজ্জপত্র।

রমনা পার্কেও কয়েকটি বিরল প্রজাতির গাছ হলো পাদাউক, পলাশ, ধারমার, কাউয়াতুতি (বনপারুল), আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওবাব, গি¬রিসিডিয়া, কর্পূর, স্কারলেট কর্ডিয়া, জহুরিচাঁপা, ক্যাশিয়া জাভানিকা, মাধবী, মালতী, আফ্রিকান টিউলিপ, কেয়া, অশোক, ট্যাবেবুয়া, পাখি ফুল, কফি, উদয়পদ্ম, সহস্রবেলী, গোল্ডেন শাওয়ার, পালাম, কাউফল, ঝুমকো, লতা পারুল, স’লপদ্ম, মহুয়া, কুর্চি, বন আসরা, চন্দন, মাকড়িশাল, দুলিচাঁপা, কনকচাঁপা ইত্যাদি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আছে গাছ হচ্ছে মিলেশিয়া, নাগলিঙ্গম, বুদ্ধ নারিকেল, পলাশ, সেতু শিমুল, হিজল, কদম, স্বর্ণচাঁপা, কদবেল, বিলেতি গাব, বড়বেল, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, নাগেশ্বরচাঁপা।


বঙ্গভবনের উলে¬খযোগ্য গাছ হচ্ছে, কদবেল, গুলানচি, কাজুবাদাম, বিলিম্বি, মিষ্টি তেঁতুল, কাউফল, নাগেশ্বর, ফাইকাস, কেশিয়া সায়মা, একাশিয়া, রাবার প¬ান্ট, শিমুল, বোতলব্রাশ, অপরাজিতা, উইপিং দেবদারু, নীলমনি লতা, নীল কণ্ঠ, মোসেন্ডা, সোনালু, ম্যাগনোলিয়া, কাঞ্চন, হৈমন্তী, সাইকাস পাম প্রভৃতি।

চন্দ্রিমা উদ্যানের জারুল, বোতল ব্রাশ, কৃষ্ণচূড়া, ও ক্যান্টিয়া পামগাছ আছে।

সংসদ ভবনের উত্তর প্ল¬াজায় আছে রানীচূড়া, মুসুন্ডা, একজোড়া, রঙন, কাঞ্চন ,পলাশ, ফিসটেইল পাম গাছ। এসব দুর্লভ গাছের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে । বৃক্ষপ্রেমিকদের দাবি, সরকার এসব সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।



বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, মে ১৫,২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।