আগের কিস্তি পড়ুন
** দিশেহারা বিএনপি-৭: অগোছালো অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বেহাল দশা
** দিশেহারা বিএনপি-৬: নেতা বহু সংগঠক নেই, রুটিনে আবদ্ধ মহাসচিব
** দিশেহারা বিএনপি-৫: সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া
** দিশেহারা বিএনপি-৪: কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন
** দিশেহারা বিএনপি-৩: নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য
** দিশেহারা বিএনপি-২ : দুর্নীতি-সুবিধাবাদে গ্রাস নেতৃত্ব
** দিশেহারা বিএনপি-১: দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প
অতি আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ প্রায়শই স্পষ্ট হয়। বিগত আন্দোলনের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন প্রায়-কোণঠাসা এবং ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম, তখন বিএনপিতে কে কোন পদ নেবে সেটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
বিএনপির বিভিন্ন সারির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও কাজ করছে ওভার-স্মার্টনেস। ঢাকা মহানগরের একজন কর্মীর বক্তব্য, ‘সবাই বলে মির্জা ফখরুল ভালো লোক, যোগ্য লোক। কিন্তু বড় বড় কথা বলা ছাড়া তিনি তো কিছুই করতে পারছেন না। স্থায়ী কমিটির এক-দু’জন তো বাক্যবাগীশরূপে প্রসিদ্ধ। ’
অপর দিকে কেউ কেউ মনে হচ্ছে একেবারে চুপসে আছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের কণ্ঠ কোথাও শোনা যাচ্ছে না। একই অবস্থা আবদুল্লাহ আল নোমানের ক্ষেত্রেও। বিপুল সংখ্যক নেতাকে এখনও সংস্কারপন্থি বলে চেপে রাখা হয়েছে। সংগঠনের কাজে লাগানো হচ্ছে না।
বিএনপির পল্টন অফিস, গুলশান অফিস, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সবাই অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। দল যে ক্ষমতাচ্যুত, এটাও মনে হয় না প্রটোকলের বহর দেখলে। কথায় বার্তায় রাজা-উজির মারায় ব্যস্ত সবাই।
বিএনপির প্রকৃত অবস্থা, প্রকাশ্য ও গোপন সীমাবদ্ধতা ও সংকট অনুধাবন করার জন্য কেউ কাজ করছে বলেই মনে হয় না। কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর নেতা, যাদের দায়িত্ব পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠানো এবং সাংবাদিকদের আপ্যায়ন করা, তারাও নিজেদের নাম ছাপানো ও ক্যামেরায় ছবি দেখাতে ব্যস্ত। দলের তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের কাছে এমন স্তরের নেতারাও ব্রাহ্মণ হয়ে আছেন।
দলের বা নেতা-কর্মীদের সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সুব্যবহারও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। সমস্যার বিষয় হলেই এক নেতা আরেক নেতাকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি চেয়ে কেন্দ্রের বিবৃতি পেতেও নাকাল হতে হচ্ছে। কখনও কখনও টাকা চাওয়ার অভিযোগও আসছে। টাকা ছাড়া বিএনপির রাজনীতিই যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এটা ঠিক যে, এতো বড় সংগঠনের সব কিছু শীর্ষ নেতা হিসেবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এককভাবে লক্ষ্য রাখতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাকে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু সে বিশ্বাস রক্ষিত হচ্ছে কিনা, সেটা দেখবে কে?
বিএনপির একজন প্রবীণ কর্মীর বক্তব্য, ‘সবাই বিএনপিকে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করছে। একজন মাত্র লোক বিএনপি করেন, তিনি খালেদা জিয়া। বাকি সবাই বিএনপির ভেতরেই নিজের দল করেন। ’
বয়সে প্রবীণ খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতে পারছেন না। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমানও দল ও নেতা-কর্মীদের থেকে বহুদূরে অবস্থান করছেন। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গত কারণেই কিছু কিছু মানুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু নির্ভরশীলরা যদি একাট্টা হয়ে সঠিক তথ্য উপস্থাপন না করেন, তখন কিছু করার থাকে না। কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য সবাই মিলে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেন, তখন সেটা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায় সম্ভবত এমনই কোটারির চক্করের কাছে জিম্মি। তারা যা বা যেমন বোঝাচ্ছেন, তেমনই বিশ্বাস করা হচ্ছে। মাঠের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অনুপস্থিত। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কে বা কারা প্রকৃত অর্থে বিএনপির জন্য কাজ করছে বা কাদের সামনে আনলে সংগঠনের লাভ হবে, সেটা বিবেচনা না করে অনুগতদের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই বিএনপিতে ত্যাগী, সংগ্রামী ও যোগ্যদের বদলে নানা নেতার ব্যক্তিগত পছন্দের অনুগতদের ঠাঁই তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এদের দ্বারা জোরদার সংগঠন বা আন্দোলন, কোনটিই করা সম্ভব হচ্ছে না।
তারেক রহমান বিএনপির কাঠামোর মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থায় সাংগঠনিক খোঁজ-খবর নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। তিনি নিজে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ-খবর নিয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তারেক রহমানের অবর্তমানে সে প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে যায়। তারেকপন্থিরা কোণঠাসা হন এবং অনেকেই তারেকের সঙ্গে সম্পর্কের তথাকথিত খবর রটিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন। এখনও দলের অনেকেই লন্ডনে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বলে দাবি করে কর্মী-সমর্থকদের সমীহ আদায় করছেন। হাওয়া ভবনের আমলে তারেকের নাম ভাঙিয়ে চলা সংস্কৃতি তারেক দেশে না থাকলে এভাবেই চলছে।
সন্দেহ নেই, নানা ধরনের সমস্যা ও সংকট অক্টোপাসের মতো বিএনপিকে প্রকাশ্যে ও গোপনে ঘিরে ধরার অন্যতম কারণ হলো, দলটি ক্ষমতায় থেকে দল সুসংগঠিত করেনি। টাকা-পয়সা, অঞ্চল ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়েছে, দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের জন্য বিশেষ কিছু করেনি। বিএনপির আমলগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও প্রোভিসি পদে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আছে। এবার আন্দোলনের সময় অনেকেই বলেছেন, ‘আন্দোলন করে কী হবে, দল ক্ষমতায় আসুক, টাকা দিয়ে কাজ করে নেবো। ’ এমন মনোভাব বিএনপির জন্য বিরাট বিপদের কারণ।
পাশাপাশি রয়েছে আত্মীয়-স্বজন ও অঞ্চল তোষণ। বিএনপির আমলে বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ বা নানা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে যত না দলের লোক ঠাঁই পেয়েছেন, তারচেয়ে বেশি জায়গা পেয়েছে নেতাদের আত্মীয়-স্বজন বা নিজের নির্বাচনী এলাকার লোক। এরাই আন্দোলন না করে নেতাদের টাকা ও তেল দিয়ে আবার ক্ষমতায় এলে সেসব উসুল করার তালে আছে। এরাই অতি আত্মবিশ্বাসীর মতো ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর। আন্দোলন-সংগ্রাম বা সংগঠন মজবুত করার কাজে এদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।
পরের কিস্তি পড়ুন: দিশেহারা বিএনপি-৯: উপেক্ষিত হয়েও সরব পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীরা
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৬ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৭