ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

প্রাঙ্গণ থেকে উদ্যানে বইমেলা, কী ভাবছেন লেখকরা?

তানিম কবির, বিভাগীয় সম্পাদক শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৪
প্রাঙ্গণ থেকে উদ্যানে বইমেলা, কী ভাবছেন লেখকরা?

বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত ২০ জানুয়ারি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মেলার উদ্বোধন, মূলমঞ্চ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্টলগুলো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের ভেতরে রাখবার সিদ্ধান্ত হলেও সার্বিক অবয়বে ঠিকই পাল্টে যাচ্ছে এবারের বইমেলা। দীর্ঘদিনের চেনা পথ, মোড়, নজরুল চত্বর, লেখক কুঞ্জ কিংবা বহেরাতলার লিটলম্যাগ চত্বর— অভ্যস্ততার কাঠামো ভেঙে এসব কিছুই নিতে যাচ্ছে এক নতুন চেহারা। সেই চেহারারই নানা সম্ভাবনা ও আশঙ্কা নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কবি লেখক।

সৈয়দ শামসুল হক: গত ২০ বছর ধরে এই দাবি তুলে এসেছি। আমি বলেছি, বইমেলা আয়োজন করা বাংলা একাডেমীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, এ মেলা সরিয়ে অন্যকোথাও নেওয়া হোক। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে লেখালেখিও করেছি আমি। সম্প্রতি অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আমি এ সিদ্ধান্তের পক্ষে।

ফরহাদ মজহার: এ ব্যাপারে স্থান সংকুলান, ব্যাবস্থাপনার জটিলতা, মেলা চলাকালীন একাডেমির অন্যান্য অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার অসুবিধা ইত্যাদি নানান যুক্তি একাডেমির কর্তামশায়েরা দিতেই পারেন। সেইসব হয়তো সত্য। সেই দিকে আমি যাবো না। ইস্যুটা অন্যত্র। বাংলা একাডেমি বই মেলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহু আগেই বিনষ্ট হয়েছে। ব্যবসা ও ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির পেশিশক্তি দেখানো ছাড়া এর আর কোন সাহিত্যিক মূল্য এখন আছে কি?  নাই। কিম্বা গবেষণার দিক থেকে দাম? তাও নাই। ঠিক না?

বাংলা একাডেমি নিছকই একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে-একদিকে ক্ষমতাসীনদের সেবা, কেরানিদের চাকুরি আর অন্য দিকে মেলার সময় বই ব্যবসায়ীদের পূজা ছাড়া একাডেমির কোন ভূমিকা নাই। বই বেচাই যদি উদ্দেশ্য হয়, বই ব্যবসায়ীরা একুশে বই মেলা সম্পর্কে যে কথা সবসময় বলে থাকেন,  তাহলে মেলা বাইরে হলেই তো সুবিধা। জায়গা বিস্তৃত হলে বাজারেরও বিস্তৃতি ঘটবে! এর আবেদন কমবে কি না সেটা একাডেমির বাইরে মেলা শুরু হলে বোঝা যাবে। একাডেমির বাইরে বই মেলা হওয়ার অর্থ বই-ব্যবসায়ীদের একাডেমির বাইরে বের করে দেওয়া। সেটা খারাপ কি? একাডেমি অঙ্গনের মধ্যে মেলা হলে তাঁরা অধিক সম্মানিত বোধ করবেন, অনেককে বলতে শুনেছি। দুই একজন এরকম ভাবতে পারেন। তবে অধিকাংশই বই বেচা হলেই খুশি। সেটা একাডেমি প্রাঙ্গনের ভেতরে হোক, কিম্বা হোক ধোলাই খালের পাড়ে, কিম্বা জিঞ্জিরায়। তো বাইরে মেলা হলে খারাপ না।

কিন্তু খারাপ সেই সব ভালো প্রকাশকদের জন্য যারা ভালো বই বের করতে চায়, সৃষ্টিশীলতাকে মূল্য দেয়, গবেষণামূলক কাজকে মূল্য দেয়। ব্যবসায় তাদের টিকে থাকা দরকার ভালো বই বের করে যাবার জন্য। বই পুরাপুরি পণ্যে পর্যবসিত হোক, এটা তারা চায় না। তাদের কথা বিশেষ ভাবে ভাবতে হবে। আর ভাবতে হবে সাহিত্য আন্দোলনের ছোট ছোট তরুণদের গ্রুপ, যারা নানান প্রতিকুলতার মধ্যে লিটলম্যাগ করে বের করে। এদের প্রতি আমার পক্ষপাত আছে। একাডেমি তাদের জন্য ভেতরে ব্যবস্থা রাখতে পারে, তাদের স্বীকৃতি ও সম্মান দেখাবার জন্য। যাতে সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য গবেষণার উপকার হয়।

দেখুন, সৃষ্টিশীল লেখালেখি সরকারি অনুদানে বা সরকারী সহযোগিতায় হয় না। একাডেমি কবি সাহিত্যিক তৈরি করে না। কবি সাহিত্যিক আছে বলে বাংলা একাডেমি আছে। ফলে বই বেচাকেনা একাডেমির ভেতরে না বাইরে, তাতে আমি বিশেষ উদ্বিগ্ন নই। যারা সাহিত্য আন্দোলনের মানুষ তারা গলিঘুঁজি কোনাকাঞ্চি বের করে তাদের লড়াই চালিয়ে যাবে। যাবেই। একাডেমি বই মেলার স্থান বদলালে তারা কিভাবে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে, পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য মেলাকে নানান দিক থেকে এমবুশ চালায়— সেইসব দেখবার আগ্রহ আছে আমার। আফটার অল, আমি তাদের সঙ্গেই একাত্মতা বোধ করি।

নির্মলেন্দু গুণ : বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে নেওয়া আমার একটি দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। ভালো লাগছে, অবশেষে সেই দাবি পূরণ হতে চলেছে। মেলার পরিবেশ পরিসর বৃদ্ধি হচ্ছে এটা অবশ্যই একটা আনন্দের ব্যাপার। এ সিদ্ধান্তে আমি আনন্দিত। মেলা হবে উদ্যানে আর আগেকার মতোই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হবে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের ভেতর। সুতরাং প্রাঙ্গণের মুখরতাও শেষ হয়ে যাচ্ছে না, বরং ছড়িয়ে পড়ছে।

রফিক আজাদ: অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এ ঐতিহ্যকে ছোট্ট ওইটুকু জায়গায় বন্দী করে রাখার কোনো মানেই হয় না। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে বইমেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিকে আমি পজেটিভভাবেই দেখতে চাই। প্রথম প্রথম অভ্যস্ততার ক্ষেত্রে কিছু সাময়িক বাধা হয়তো আসবে, কিন্তু সেসব কেটেও যাবে সময় হলে। তবে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, মেলাকে কেন্দ্র করে উদ্যানের গাছপালার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আমি এর বিপক্ষে, বাঙলা একাডেমীর সাথে আমাদের ইমোশন, প্রেম, স্মৃতি সব জড়িয়ে আছে। আমার মনে হয় একুশে মেলার ৫০% স্টল অনায়াসে বাদ দেয়া যায়। বাঙলা একাডেমী প্রাঙ্গণ একটা ইমোশনের ব্যাপার, ভালোবাসার তীর্থস্থান। আমি এটাকে সরানোর পক্ষপাতী নই। লিটলম্যাগ চত্বর, একাডেমির সিঁড়ির আড্ডাস্থল, নজরুল চত্বর, ভাষা শহীদের ভাস্কর্য, সর্বোপরি একুশের ইতিহাস মিলে যে পরিবেশটা আছে তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কেন, জগতের আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

কামরুজ্জামান কামু: বইমেলা সম্প্রসারণ হচ্ছে, এটা তো ভালো। যেখানে বইমেলা হচ্ছিল, বই বেচা-কেনার জন্য সেই জায়গাকে অপ্রতুল মনে হওয়া মানে তো বইয়ের বাজার আগের চাইতে ভালো হয়েছে, পাঠক বেড়েছে। বইমেলার এই সম্প্রসারণকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি আমি। তবে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণকে ঘিরে যারা আবেগ আক্রান্ত, যারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধী— তাদের সেই মত বা বিরোধিতার প্রতিও আমি সম্মান প্রদর্শন করতে চাই।

মাহবুব মোর্শেদ: আমার মতে এটি একটি উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে জমবার কোনো কারণও নেই। যেমন ফাঙ্কফুর্টের বইমেলাও হয়তো অন্যকোনো শহরে গিয়ে জমবে না। সারাবছর অনেক ধরনের বইমেলাই তো হয়, সেগুলোকে জমানোর চেষ্টা করা যেতে পারতো। অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ সম্পর্কিত, এ সম্পর্ককে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।