ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

এসেই হারিয়ে যাচ্ছেন নতুন লেখক-প্রকাশকরা!

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
এসেই হারিয়ে যাচ্ছেন নতুন লেখক-প্রকাশকরা! বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ। ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: ‘জনপ্রিয় ও তরুণ, নতুন সুলেখকদের ভালো মানের বড় সংখ্যক বইমেলায় এনেও কেবলমাত্র স্টল বরাদ্দ-বিন্যাসের দুর্বলতায় মার খেয়ে গেলাম। এভাবে কি এগোতে পারবেন নতুন লেখক-প্রকাশকরা?’

প্রকাশনা সংস্থা ‘পাললিক সৌরভ’ এর প্রধান নির্বাহী ও প্রকাশক মেহেদী হাসান শোয়েবের এ আক্ষেপ শেষ পর্যায়ে পৌছা অমর একুশে গ্রন্থমেলার অনেক প্রকাশকেরই।

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) শেষ হতে যাওয়া বইমেলার মাঝখানে বাকি আর মাত্র একদিন।

অথচ বড় বিনিয়োগে বড় ক্ষতির মুখোমুখি বলে দাবি করছেন তারা।

দেশের বইয়ের প্রধান এ মেলায় পুরনো ও প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি প্রতি বছরই যোগ হন নতুন নতুন প্রকাশক। প্রাণের মেলার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চান নতুন নতুন লেখকও। কিন্তু দু’এক বছরের মধ্যে ঝরে পড়েন, হারিয়ে যান তারা। ফের একদল যেমন দ্রুত আসেন, তেমনি দ্রুত সরেও পড়েন।  

এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ৪১২ নম্বর স্টল বরাদ্দ পেয়েছে গত বছর থেকে মেলায় অংশ নেওয়া ‘পাললিক সৌরভ’। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, পূরবী বসু থেকে শুরু করে দেশবরেণ্য এবং তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের বই প্রকাশ করে সাড়া ফেলেছে ইতোমধ্যেই। আলোড়ন তুলেছে যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীর বিচারের রায় বই এনেও।  
 
মাত্র দু’বছরে ৬২টি সৃজনশীল ও মৌলিক বই নিয়ে আসা নবীন-তরুণ প্রকাশক শোয়েব বলেন, ‘বড় জায়গাজুড়ে থাকা ১৩টি প্যাভিলিয়নসহ ২৫টি বড় স্টলে পাঠক-ক্রেতারা ঢুকে যাচ্ছেন। ফলে আমরা ছোট প্রকাশকরা মার খাচ্ছি’।

নানা সমস্যায় হারিয়ে যান নতুন লেখক-প্রকাশকরাগতবার সাত লাখ টাকার বই বিক্রি হলেও এবার সোয়া লাখও পেরোবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্যাভিলিয়নসহ বড় স্টলগুলো একটি সীমাবদ্ধ অংশে রয়ে গেছে, তারাই দখল করে রাখছে এ জায়গাটুকু। পুরো সোহরাওয়ার্দী অংশে তাদের মাঝে দূরত্ব রেখে রেখে বিন্যস্ত করলে সবাই সমান গুরুত্ব-সুযোগ পেতো’।      
 
এটিকে ‘বড়গুলোর কাছে ছোট স্টলগুলোর ধরা খাওয়া’ বলেও মন্তব্য করেন শোয়েব।

আরও কিছু অভিযোগ যোগ করে নতুনদের প্রতি বাংলা একাডেমির অবহেলা, স্টল বরাদ্দে বৈষম্য, ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ বেশি পড়া এবং পাইরেসি বই প্রকাশ ও বিক্রিকে ব্যবসায় ক্ষতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন এবার মেলায় প্রথম আসা ‘কিশোর কলম’ এর প্রকাশক বশীরুজ্জামান বশীর।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রাতিষ্ঠানিক ছাড়া সব বইয়ের স্টল এবার ১২টি চত্বরজুড়ে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে ঠাঁই মেলেনি তার। বাংলা একাডেমি অংশের লিটল ম্যাগ চত্বরের ৫ নম্বর স্টলে বই বিক্রি করা এই প্রকাশক বলেন, ‘নতুনদের জন্য স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিকে উদার-সহানুভূতিশীল হতে হবে। স্টল ভাড়া বিক্রির তুলনায় তিনগুণ পড়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের তৎপরতা শিথিল, তাই পাইরেসি বই প্রকাশ-বিক্রি এখনও হচ্ছে। এসব কারণে মৌলিক-সৃজনশীল ভালো বই বের করেও এবারের মেলায় প্রচুর ক্ষতির মুখে রয়েছি’।

‘পাইরেসির বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমির ভূমিকা জোরালো হতে হবে’।            

এদিকে পর্যাপ্ত ও ভালো মানের বই থাকা সত্ত্বেও স্টল পায়নি ‘বাবুই’। লিটল ম্যাগ চত্বরেই নিজেদের প্রকাশনা ‘ছড়া আনন্দ’ এর ৩০ নম্বর স্টলে বই রয়েছে শিশুতোষ প্রকাশনা সংস্থাটির। প্রকাশক শিশু সাহিত্যিক কাদের বাবু বলেন, ‘ভালো কাজ করলেও নতুনদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।   এতে তরুণরা লোকসানে পড়ে উৎসাহ হারিয়ে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন’।

‘বাবুই’র বই তালিকায় রয়েছে আসাদ চৌধুরী, আখতার হুসেন, ফারুক নওয়াজ, আমীরুল ইসলাম, জাকির তালুকদার, তুষার আব্দুল্লাহসহ খ্যাতিমানদের পাশাপাশি মেধাবী সম্ভাবনাময় তরুণদের লেখা নানা স্বাদের মানসম্মত বই। অথচ কেন যে স্টল পেলাম না, বুঝতেই পারলাম না!’

কাদের বাবুর মতে, ‘নতুনদের প্রণোদনা দিতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, আরও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই নতুনদের পদভারে আরও সমৃদ্ধ হবে প্রকাশনাশিল্প’।
 
নতুন প্রকাশকদের আরও অভিযোগ, তারা প্রকাশনাশিল্পে আসতে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। নতুনরা ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে আসছেন, তাদের কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে। ফলে ভালো প্রকাশনা নিয়ে নতুন কেউ এলে তাদের ব্যবসা থাকবে না মনে করে পুরনো ও জ্যেষ্ঠ প্রকাশকরা ভয় পেয়ে নতুনদের স্থান দিতে চান না।

এসব কারণে প্রকাশনা ব্যবসায় আসতে চাচ্ছেন না তরুণরা। এলেও বেশিরভাগই টিকতে পারছেন না। লোকসান দিয়ে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

আর রয়্যালিটি পাওয়া দূরের কথা, প্রকাশকদেরকে গাঁটের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেও বিক্রি না হওয়ায় হতাশায়-ক্ষোভে-ক্ষতি মেনে নিয়ে সরে যাচ্ছেন লেখকরাও।  

গত তিন বছর ধরে বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত পরিসরে বইমেলা সম্প্রসারণ এবং কিছু প্রাতিষ্ঠানিক স্টল ও লিটল ম্যাগ চত্বর ছাড়া বাকি সব স্টল-প্যাভিলিয়ন নিয়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালের পর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার বর্ধিত আয়োজন এবং কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া নিরাপত্তা নিয়ে দুই জায়গায় মেলা বসা নিয়ে খুশি-আনন্দিত সব বয়সী ক্রেতা-পাঠক-দর্শনার্থীরা।

কিন্তু এসব কর্তৃপক্ষের এসব অপরিকল্পিত পদক্ষেপ, আর পাঠক-ক্রেতাদের দুই জায়গায় ছোটা-ছুটির ক্লান্তি, পরিশ্রম, দুর্ভোগে এবার বই বিক্রি কমেছে বলে অভিযোগ নতুন লেখক-প্রকাশকদের।

উৎসাহ-পণোদনা পাচ্ছেন না নতুনরাতবে বিপরীত চিত্রও আছে। এ বছরই প্রথম সোহরাওয়ার্দী অংশের শিশু চত্বরে স্টল পাওয়া ‘সপ্তডিঙা’র (শুধু ছোটদের বই) প্রকাশক শিশু সাহিত্যিক নাফে নজরুল বলেন, ‘ভালো বই পেলে পাঠক কিনবেনই। প্রথম বছরেই আমরা শওকত ওসমান থেকে শুরু করে আমীরুল ইসলাম পর্যন্ত বিখ্যাতদের শিশুতোষ বই নিয়ে এসেছি। আছেন নতুনরাও। সব মিলিয়ে ২৫টি মৌলিক, সৃজনশীল ও ক্লাসিক বই করেছি, যার বিক্রি যতোটুকু আশা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি’।  

হতাশ নন অবশ্য মেহেদী হাসান শোয়েবও। ‘দুই বছরের অভিজ্ঞতায় শিখছি। প্রকাশনা শিল্প টেকানো ও টিকে থাকা কঠিন বলে হতাশা শোনা যায়। আমরা চিন্তিত, তবে হতাশ নই। নতুন পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা নিয়ে এগোলেই কাজটি সহজ হবে, সুন্দর হবে। আরও এগিয়ে যাবে প্রকাশনাশিল্প, বইমেলা, বাংলা সাহিত্য’।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।