ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

মানের প্রশ্নে আপসহীন তরুণ প্রকাশকরা

ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৯
মানের প্রশ্নে আপসহীন তরুণ প্রকাশকরা বইমেলায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বই দেখছেন এক পাঠক | ছবি: ডিএইচ বাদল

অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: প্রকাশিত বইয়ের ২৫ শতাংশ মানসম্পন্ন বই থাকলেই গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় প্রকাশনীগুলো। সেই বিচারে বাংলা একাডেমি বলছে, অনেক পুরনো প্রকাশনীর চেয়ে বইয়ের মান বিচারে এগিয়ে আছে তরুণ প্রকাশকরা।

তবে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি, ছাপায় সেকেলে প্রযুক্তি, সম্পাদনায় লোকবল কম, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির অসহযোগিতা; প্রকাশনা ব্যবসার শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা।

প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মানের প্রশ্নে অবশ্য ছাড় দিতে চান না তরুণ প্রকাশকরা।

তারা বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বইয়ের মান ধরে রাখা। মানসম্মত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা নিজ উদ্যোগে আলাদা সম্পাদনা পর্ষদ খুলছেন, যার কয়েকটিতে যুক্ত খ্যাতনামা লেখকদের কেউ কেউ।

এবারের বইমেলায় তরুণ প্রকাশকদের মধ্যে কেউ এসেছেন লিটল ম্যাগ আঙিনা থেকে, কেউ এসেছেন মফস্বল থেকে, কেউবা আবার প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছেন নিজের প্রথম উপার্জনের সবটুকু বিনিয়োগ করে। খ্যাতনামা লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের বই প্রকাশেও তারা আছেন এগিয়ে।

নতুন ১৬টিসহ শতাধিক বই নিয়ে মেলায় প্রথমবার অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন এইচ এম সাদী খানের ‘শব্দভূমি’ প্রকাশনা। সাদী খান জানান, প্রকাশনা ব্যবসায় তার এক বছরও পেরোয়নি। মেলায় অংশ নিতে তিনি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও ঋণ করেছেন।

শব্দভূমি থেকে কবি আসাদ চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ও গল্প সংকলনের পাশাপাশি বেশকজন তরুণ লেখকের উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন ও ভ্রমণ বিষয়ক বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রকাশনার সম্পাদনা পর্ষদে রয়েছেন আসলাম সানী, আহমেদ ফারুক ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক রেহান কৌশিক। বই প্রকাশের আগে তারা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় বিশেষ মনোযোগী হন বলে জানিয়েছেন প্রকাশক।

লিটল ম্যাগ চত্বর থেকে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল মিলেছে ‘ভিন্ন চোখে’ প্রকাশনীর। এবার ২৩টি নতুন বইয়ের পাশাপাশি ১১৭টি বই রয়েছে এ প্রকাশনায়। ভিন্ন চোখের স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান বলেন, ভিন্ন চোখে আর পোস্টমর্টেম- নামে দুটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করতে গিয়ে বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো প্রকাশনা বড় করব। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা একত্রিত হয়ে প্রকাশনা শুরু করলাম।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার শনিবারের চিত্র | ছবি: ডিএইচ বাদল আলী আফজাল খান বলেন, লিটল ম্যাগ সম্পাদনার সময় আমাদের আলাদা একটি সম্পাদনা পর্ষদ ছিল। সেই একই পর্ষদ এবার বইমেলার পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করেছে। সহজ ও নির্ভুল বানানরীতি, বাক্য বিন্যাস এসব বিষয়ে নজর রেখেছি।

শুধু মান নয়, বইয়ের রয়্যালিটি ইস্যুতেও সতর্ক অবস্থানে তরুণ প্রকাশকরা। এ প্রসঙ্গে সিলেটের ‘বাসিয়া’ প্রকাশনীর প্রকাশক নওয়াব আলী বলেন, মফস্বলের প্রকাশনী বলে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকেই আমাদের পাণ্ডুলিপি দিতে চান না। যারা দিচ্ছেন, তাদের রয়্যালিটি আমরা আলোচনা সাপেক্ষে দিচ্ছি। বিশেষ পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে সাইনিং মানি, রয়্যালিটি একটু বেশি হয়। তরুণদের ক্ষেত্রেও আমরা সতর্ক, লক্ষ্য রাখি, তারা যেন নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে।

প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ৪০টি নতুন বইয়ের পাশাপাশি দুই শতাধিক বই এনেছেন মেলাতে। তারা প্রাধান্য দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ও সিলেটের মরমি গানকে। ২০০৫ সালে প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এর আগে মেলেনি সুযোগ।

এ প্রসঙ্গে বাসিয়ার প্রকাশক বলেন, মানসম্মত বই প্রকাশের শর্ত তো রয়েছে, পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই প্রকাশ করতে হবে বলেও বাংলা একাডেমির অলিখিত একটা শর্ত আছে। সেই শর্ত পূরণে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। খ্যাতনামা লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দুরুহ ব্যাপার। তাদের লেখা সংগ্রহ করা, রয়্যালিটি ইস্যু- এসব তো চাট্টিখানি কথা নয়।

ঢাকার কেরানিগঞ্জ উপজেলার জলতরঙ্গ প্রকাশনা গত তিন বছর ধরে ছিল বাংলা একাডেমির বহেরাতলার লিটল ম্যাগ চত্বরে। এর স্বত্বাধিকারী তরুণ প্রকাশক সোলায়মান শিপন নিজের টিউশনির সব টাকা জমিয়ে এবার গ্রন্থমেলার স্টল বরাদ্দের অর্থ পরিশোধ করেছেন। এখন এই প্রকাশনাই তার মূল পেশা। গল্প, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে ৩৫টি নতুন বই এবার প্রকাশ করেছেন তিনি।

লিটল ম্যাগ চত্বর থেকে প্রথমবারের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঠাঁই পেয়েছে ‘নৃ’। ছয় লেখক বন্ধুর প্রতিষ্ঠানটি এবার বইমেলায় ২৫টি নতুন বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে যার ১৫টি ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে।

এদিকে সবকিছুর বাইরে নতুন ও তরুণ প্রকাশকদের আছে কিছু অভিযোগ। কাগজের মূল্য বৃদ্ধির পর বাঁধাই, সম্পাদনায় পুস্তক প্রকাশক সমিতির ‘সিন্ডিকেট বিজনেসের’ অভিযোগ এনে তরুণ প্রকাশক সাদী খান বলেন, সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিকে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনাকে অনুপ্রেরণা দিতে সরকারেরও এগিয়ে আসতে হবে।

ভিন্ন চোখে’র স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান বলেন, প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বই বিপণন প্রক্রিয়া এখনও পেশাদারিত্বের জায়গায় পৌঁছায়নি। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বড় বুক স্টলগুলোতে যখন আমরা বই দিয়ে আসছি, তখন সেখান থেকে বই বিক্রির অর্থ আমরা ঠিকমতো পায় না। অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো তখনই ভরসা।

এদিকে তরুণ প্রকাশকদের বিষয়ে ইতিবাচক ধারণাই পোষণ করছে মেলার দুই আয়োজক বাংলা একাডেমি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, মানসম্মত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তরুণ প্রকাশকরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছেন অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী থেকে। শতকরা হিসাব করতে গেলেও অনুপাতে অনেক ক্ষেত্রে নতুনরা এগিয়ে থাকে।

বাসিয়ার নওয়াব আলী প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই প্রকাশের যে শর্তের কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরণের কোনো নির্দেশনা বাংলা একাডেমি থেকে কখনও দেওয়া হয় না।

জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ জানান, তরুণ প্রকাশকদের মধ্যে অনেকেই এখন নিরীক্ষাধর্মী বই প্রকাশে এগিয়ে আসছে। ভালো ভালো বই বের করার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠিতদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারাও সামিল হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৯
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।