ঢাকা: নববর্ষ মানেই হালখাতা। আর হালখাতা মানেই দেনার হিসাব চুকানো।
‘স্যার, আমি ক্ষুদ্র ইটভাটার মালিক। এতো বছর ধরে সামান্য রাজস্ব দেই, কখনো এমন সম্মান পাইনি। আজ সম্মান পেয়ে রাজস্ব বিভাগের প্রতি ধারণা পাল্টে গেল’। একগাল হাসি দিয়ে এমন উক্তি যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের হালখাতায় বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতে আসা স্থানীয় একজন ইটভাটা মালিকের।
সম্প্রতি বকেয়া রাজস্ব আদায় ও করদাতার মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিতে যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ব্যতিক্রমী এ হালখাতার আয়োজন করে।
‘সর্বত্র রাজস্ব সংস্কৃতি চালু করতে হবে’- এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের মধ্যে সর্ব প্রথম কোনো কমিশনারেট এমন আয়োজন করে।
গত ১৭ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান বকেয়া রাজস্ব আদায়ে হালখাতা করার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘সম্রাট আকবর রাজকোষের বকেয়া আদায়ে নববর্ষে হালখাতার প্রচলন করেন। সে সময় থেকে বকেয়া আদায়ে হালখাতা করা হচ্ছে’।
আয়কর, শুল্ক ও মূসকে অনেক বকেয়া রাজস্ব রয়েছে। এনবিআর পহেলা বৈশাখের মতো হালখাতার মাধ্যমে বকেয়া কর আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, হালখাতার সব রুপ আর ‘বকেয়া রাজস্ব আদায়ে হালখাতা’ ব্যানারে সাজানো হয় কমিশনারেটের সদর দফতরের ‘কপোতাক্ষ’।
হালখাতা বলে কথা, তার জন্য ভোক্তাকে (করদাতা) এক সপ্তাহ আগেই কার্ড দেওয়া হয়। আমন্ত্রণপ্রাপ্তরা ছিলেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভর্তিতে সরাসরি অবদান রাখা ভোক্তা। হোক মফস্বল এলাকা, তাতে কি? সম্মানের সঙ্গে পৌঁছানো হয় কার্ড। তাতে রেসপন্স (সাড়া) করেন ১০৭ জন ভোক্তা। নির্দিষ্ট দিনে হালখাতা করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
হালখাতার চিরাচরিত নিয়ম মেনে মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে আনা হয় দধি, খই, মিষ্টি আর সিঙ্গারা। আর সঙ্গে মৌসুমি ফল লিচু। এসব দিয়ে চলে মিষ্টিমুখ করানো।
মো. জামাল উদ্দিন যোগ করেন, শুধু মিষ্টিমুখ নয়। এসব করদাতাদের সম্মানিত করতে আনা হয় ফুল। পাওনা পরিশোধ শেষে দেওয়া হয় ছোট্ট একটি গিফটও।
মুদি, চা, আড়ৎ সব জায়গায় হালখাতা হয়। কর অফিসে হালখাতা! কার্ড পেয়ে অনেকেই হতবাক, অনেকেই খুশি। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির পাল্লা বোধ হয় ভারি হবে।
নির্দিষ্ট দিনে আসা বকেয়া করদাতাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। হালখাতার মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কথা জানানো হয় স্টেকহোল্ডারদের (করদাতা)।
করদাতাদের পরামর্শ শোনা হয়। আশ্বস্ত করা হয়-বর্তমান এনবিআর রাজস্ব ও করদাতাবান্ধব। করদাতা-কর সেবাদানকারীদের মধ্যে দূরত্ব কমাতে এমন উদ্যোগ।
কমিশনারের ভাষ্য, মফস্বল এলাকা হিসেবে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বকেয়া রাজস্ব আদায় হয়। ক্ষুদ্র হলেও হালখাতার মতো এমন উদ্যোগ দেখে করভীতি দূর হয়।
কার্ডে ১০৭ জন করদাতা রেসপন্স করেন। ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আর ‘জনকল্যাণে রাজস্ব’ এ স্লোগানকে স্বাগত জানিয়ে হাজির হন ১৩০ জন বকেয়া করদাতা।
ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে কমিশনারের হাতে বকেয়া রাজস্ব তুলে দেন তারা। কমিশনার তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। মিষ্টিমুখের পাশাপাশি তুলে দেন উপহার সামগ্রী।
কমিশনার বলেন, বকেয়া রাজস্ব দু’ কোটি টাকার বেশি হবে না। হালখাতায় ৮৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ টাকা আদায় হয়। অ্যাপায়ন, আতিথিয়েতায় মুগ্ধ করদাতারা।
এ হালখাতার মাধ্যমে করদাতাদের সঙ্গে এনবিআরের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হল। করদাতারা এ ধরনের উদ্যোগের জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদও জানান।
কমিশনার মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এ পরিমাণ বকেয়া রাজস্ব আদায়ে জনবল ও সময় খরচ করতে হতো। তা থেকে বেঁচে গেছি। করদাতাদের সঙ্গে বেশি দেখা হয় না, সমস্যা থাকে- এসবও দূর হয়ে গেল’।
তিনি বলেন, ‘এনবিআর থেকে মৌখিকভাবে এমন উদ্যোগের কথা জেনে আয়োজন করেছি। অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি, ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হবে’।
চেয়ারম্যানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যশোর কমিশনারেট মাত্র ২ কোটি টাকার বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য এ হালখাতার আয়োজন করেছে। দেশের অনেক কমিশনারেটের বকেয়া শত থেকে হাজার কোটি টাকা। যশোর থেকে শিক্ষা নিয়ে সব কমিশনারেট এ সংস্কৃতি চালু করবে বলে মনে করেন রাজস্ব কর্মকর্তারা।
হালখাতার মাধ্যমে রাজস্ব সংস্কৃতিতে নতুনমাত্রা যোগ করায় যশোর কমিশনারেটকে স্বাগত জানান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষ পর্যায়ে আছি, এখন আমাদের রাজস্ব আহরণের চূড়ান্ত হিসাব নিতে হবে। হালখাতার মতো ভিন্ন উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ের সকল কমিশনারদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৬
আরইউ/এএসআর