ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বাজেট

বাজেট বিকেলে: রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৯
বাজেট বিকেলে: রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ প্রতীকী ছবি

ঢাকা: নতুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হবে বৃহস্পতিবার (১৩ জুন)। জাতীয় সংসদে বিকেল ৩টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে এ খসড়া বাজেট পেশ করবেন।

এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট। আর বাংলাদেশের ৪৮তম, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর চলতি মেয়াদের প্রথম ও টানা ১১তম বাজেট।

প্রাথমিকভাবে আসছে বাজেটের মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এবারের বাজেটে বড় আকারের ব্যয় মেটাতে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৩ দশমিক ১ শতাংশের সমান। বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে। ফলে বড় আকারের বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায়ের ওপর জোর দেওয়া হলেও নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

এজন্য আসছে বাজেটে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বড় সংস্কারে কথা উল্লেখ থাকবে। তবে করের পরিমাণ না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে। ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে নতুন ভ্যাট আইন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরও শক্তিশালী করা হবে। আউটসোর্সিং করে বাড়ানো হবে এর জনবল। রাজধানীর ভবন মালিকদের থেকে কর আদায় করার ঘোষণা থাকবে নতুন বাজেটে। ১০ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে নিয়োগ দিয়ে ছয় মাসে নতুন ৮৫ লাখ করদাতা খুঁজে বের করা হবে। জনগণকে রাখা হবে ভ্যাট ও করের চাপমুক্ত। কর্পোরেট করসহ ক্ষেত্রবিশেষে কর হার কমানো হবে। তবে সাধারণ মানুষের করমুক্ত আয়ের সীমায় বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। অবশ্য আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে দেশের সব বন্দরে বসানো হবে স্ক্যানার মেশিন। এসব লক্ষ্য সামনে রেখেই নতুন অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবারই বাজেটের আয়-ব্যয়ের এই চিত্র দেখা গেলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া রাজস্ব আদায়ে বড় লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব নয়। আর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতির ওপর চাপ বাড়বে।

এদিকে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরু থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সংস্থাটি রাজস্ব আয় করেছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আর কোনো আশা না থাকায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য কমিয়ে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪৫ হাজার ৬০০ টাকা বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে। ফলে নতুন বাজেটে রাজস্ব বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য প্রান্তিক পর্যায়ে রাজস্ব অফিস নিয়ে যাওয়া হবে।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সংবাদমাধ্যমকে জানান, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরু থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। ফলে নতুন বাজেটে রাজস্ব বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য প্রান্তিক পর্যায়ে রাজস্ব অফিস নিয়ে যেতে হবে। রাজস্ব আহরণে আমাদের তিনটি বড় সমস্যা রয়েছে। আওতা বাড়াতে হবে। সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংক হিসাবে মানুষের টাকা জমছে। এই অর্থ করের আওতায় আনতে হবে। কর অবকাশে শৃঙ্খলা আনতে হবে।  

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই বাজেটের আকার বড়, কিন্তু মানে ছোট। এই বাজেটে জিডিপির ১৯ শতাংশ পূরণ হওয়ার কথা থাকলেও ১৭ শতাংশও পূরণ হবে না। বছর শেষে আমরা দেখবো, ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা থাকলেও ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকাও আদায় হবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসছে বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করের পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত করের পরিমাণ ধরা হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান ধরা হচ্ছে চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে।

আয়-ব্যয়ের বিশাল পার্থক্যের কারণে এবার বাজেট ঘাটতিও অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে ২০ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ওই ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার। এটি বিদায়ী অর্থবছরে রয়েছে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে এর পরিমাণ ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণ খাতের মধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে এর পরিমাণ রয়েছে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে এর পরিমাণ ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা।  

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সূত্র বলছে, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করা হলেও প্রতিবারই কিছু পরিবর্তন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও কিছু পরিবর্তন করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো উদ্যোগ থাকবে বেকারদের জন্য ঋণ তহবিল (স্টার্টআপ ফান্ড)। এ তহবিল থেকে স্বল্পসুদে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন বেকাররা। কৃষকের জন্য ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসেবে চালু করা হবে শস্যবিমা। নতুন উদ্যোগের মধ্যে থাকছে প্রবাসীদের জন্য বিমা সুবিধা। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আসন্ন বাজেটে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৩ লাখ বাড়িয়ে ৮৭ লাখে উন্নীত করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হবে। দেশের দরিদ্র ১৫ হাজার ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগীর আর্থিক সুবিধা দ্বিগুণ করা হবে। বরাদ্দ বাড়ানো হবে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে। এছাড়া বাজেটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালনের প্রতিফলন থাকবে।

স্বাধীনতার ৪৮ চল্লিশ বছরে জাতীয় বাজেটের আকার বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ৬৭০ গুণ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে আগামী অর্থবছরের নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ১০ বছরে বাজেটের আকার বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণেরও বেশি। বাজেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘাটতিও। তবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে এই বাজেট ৭ লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই সময়ের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাওয়ারও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৯
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।