ঢাকা: সারা দেশের ওপর দিয়েই তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। টানা ২৯ দিনের তাপদাহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
আবার শীতকালে কিন্তু এর উল্টোটাই ঘটে। গত জানুয়ারিতে দেশের তাপমাত্রা যখন পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এলো, তখন অনুভব হচ্ছিল তার চেয়েও কম। প্রচণ্ড ঠান্ডার অনুভূতি নিয়ে মানুষ তখন কাতরাচ্ছিল।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রকৃত তাপমাত্রার সঙ্গে ‘ফিলস লাইক’ বিষয়টির পেছনে দায়ী মানবদেহও। তাদের মতে, শীতে বাতাস শুষ্ক থাকে। জলীয় বাষ্পও কম থাকে। অর্থাৎ মানবদেহের চেয়ে বাতাসের তাপমাত্রা কম থাকে। ফলে শরীর তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না। এতে বাতাসের প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে আরও কম অনুভব হয়।
অন্যদিকে, গরমকালে সাধারণত বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে। এতে শরীর তাপমাত্রা বাইরে ছাড়তে পারে না। ফলে প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে আরও বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়।
এছাড়া, আবহাওয়া অফিস যে পদ্ধতিতে তাপমাত্রা পরিমাপ করে, সেই পদ্ধতিতে সরাসরি থার্মোমিটারের গায়ে রোদের তাপ লাগানো হয় না। স্টিভেনসন স্ক্রিনে থার্মোমিটার রেখে তাপমাত্রা মাপা হয়। এতে কেবল বাতাসের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ কারণে বাইরে বের হলে যে তাপ অনুভূত হয়, আর আবহাওয়া অফিস যে তাপমাত্রা পরিমাপ করে তার মধ্যে পার্থক্য থাকে।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, রোববার (২৮ এপ্রিল) বিকেল তিনটায় ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর ‘ফিলস লাইক’ ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এমনটাই হওয়ার কথা। মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৯ বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীর থেকে যে তাপ বের হচ্ছে, এতে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। আর সেই ঘাম বাতাসে মিশতে পারছে না। কেননা, বাতাসে তাপমাত্রা শরীরের চেয়ে বেশি। সেখানে জলীয় বাষ্পও বেশি। শরীরের তাপমাত্রা বাতাসে মিশতে না পারায় প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে আরও বেশি অনুভূত হয়।
আবার শীতকালে উল্টোটা ঘটে। বাতাসের জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে। একইসঙ্গে তাপমাত্রাও কম থাকে। ফলে শরীর থেকে তাপ বেরিয়ে যায়। মানবদেহ তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না। ফলে ‘ফিলস লাইক’ কম দেখায়।
এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, মানবদেহ নিজেও বেশি গরম অনুভূত হওয়ার জন্য দায়ী। কেননা, দেহ তাপ ছাড়ে। আবার বাতাসও তাপ ছাড়ে। আর দু'দিকের তাপ এসে লাগে চামড়ায়। শরীর ঘেমে ওঠে। কিন্তু বাতাসে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প থাকায় শরীরের ঘাম শুকাতে চায় না। ফলে শরীরের তাপ বের হতে বাধা পায়। এতে যে গরম অনুভূত হয় সেটা প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, মানবদেহের ভেতরে তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় বেশি। তাপমাত্রার ধর্মই হচ্ছে তীব্র থেকে কমের দিকে ধাবমান হওয়া। ফলে বেশি থেকে কমের দিকে অর্থাৎ চামড়া বা ত্বকের দিকে আসে ভেতরের তাপ। আর বাতাসের তাপও ত্বকের থেকে বেশি। সেটাও ধাবিত হয় ত্বকের দিকে। এই অবস্থায় শরীরের তাপ নির্বিঘ্নে বাইরে বের হয়ে আসতে পারে না। ফলে ঘাম সৃষ্টি হয়, তা আবার বাতাসে মিশতেও পারে না। কারণ, বাতাসে আগে থেকেই জলীয় বাষ্প বেশি। তাই শরীরের ত্বক হয়ে ওঠে স্যাঁতস্যাঁতে। এই অবস্থায় বেশি গরম অনুভূত হয়।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, আমাদের দেশে এমন কোনো সার্ভে নেই যার মাধ্যমে বলা যাবে তাপমাত্রা কত থাকলে ‘ফিলস লাইক’ কত হবে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থার হয়তো সেই সার্ভে আছে। তারা সেভাবেই একটা তথ্য দেয়। গুগল করলে যে ‘ফিলস লাইক’ পাওয়া যায়, সেটা আমাদের দেশের কোনো তথ্য নয়। তারা হয়তো তাদের মতো করে দেয়।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, স্টিভেনসন স্ক্রিন পদ্ধতি হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই পদ্ধতিতে থার্মোমিটারে সরাসরি রোদ লাগানো হয় না বা মাটির তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় না। এতে কেবল বাতাসের তাপ ও আর্দ্রতা মাপা হয়। তাই বাইরে গেলে যে তাপমাত্রা গায়ে অনুভব হয় তার সঙ্গে পার্থক্য থাকে।
দেশের ওপর দিয়ে গত ৩১ মার্চ থেকে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত ৭৬ বছরের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গত ২৬ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল চলতি বছরের সর্বোচ্চ।
২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল আগের নয় বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ঈশ্বরদীতে, ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ২০১৪ সালের মে মাসে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল আগের ৫৮ বছরের মধ্যে ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ, ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এই রেকর্ড এখনও ভাঙেনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৪
ইইউডি/এসআইএ