কুয়াকাটা, পটুয়াখালী: কুয়াকাটায় শুটকি উৎপাদন দিন দিন কমছে। এবার শুটকি উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই পল্লীতে ব্যবসায়ী আর শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কমেছে।
সরেজমিন পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, এককালে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় ছিল অনেক বড় শুটকি পল্লী। মাছধরা, মাছ শুকানো, আর শুটকি বাজারজাতকরণে শত শত শ্রমিক কাজ করতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে সে চিত্র বদলে গেছে। শুটকির জন্য সমুদ্রে মাছের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। বাজারজাতকরণেও রয়েছে অনেক সমস্যা।
এদিকে, পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার কারণে শুটকি পল্লী সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যত্র। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের পূর্বদিকে গঙ্গামতির চরের বনের ধারে রয়েছে একটি শুটকি পল্লী। অন্যদিকে, পশ্চিম দিকে রয়েছে দু’টি শুটকি পল্লী। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, মাছ খুবই কম। ফলে শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কম।
কুয়াকাটায় উৎপাদিত শুটকির রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। এখানে যেসব মাছের শুটকি তৈরি হয়, তার মধ্যে রয়েছে লইট্টা, ফাহা, ফালিসা, চাবল, কোরাল, হাঙ্গর, ছুরি, পোমা, চান্দাকাটা, চিংড়ি, নোনা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। মাছ কিনারে তোলার পর ভালো করে ধোয়া হয়। এরপর লবন মিশিয়ে মাঁচার ওপরে বিছিয়ে শুকানো হয়। পরে সংলগ্ন বাসায় সংরক্ষণ করে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মোকামে পাঠানো হয়। এখানকার শুটকি বেশ কয়েকটি দেশেও চালান হয়।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। মৌসুমের শুরুতে কোথাও শুটকি উৎপাদনের আয়োজন করা হলে হঠাৎ করেই পল্লী উচ্ছেদ করা হয়। এভাবে শুটকি ব্যবসায়ীরা বার বার লোকসান দেওয়ার কারণে অনেকে ব্যবসায়ে আগ্রহ হারাচ্ছে।
শুটকি ব্যবসায়ী আমীর হোসেন বলেন, এক সময় মৌসুমের শুরুতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় দীর্ঘদিন ব্যবসায় লোকসান দিতে হয়েছে। এখন আবার মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, দস্যুদের তাণ্ডবেও অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
সূত্র বলছে, এক সময় ব্যবসায়ী, আড়ৎ মালিক ও শ্রমিকসহ অন্তত ৩০০ পরিবারের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম ছিল এই শুটকি ব্যবসা। এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে আরও অন্তত সহস্রারাধিক পরিবার। এদের পরিবারে এখন চরম দুরাবস্থা বিরাজ করছে। কেউ কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছে, কেউ বেকার জীবন কাটাচ্ছে।
কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের কাছে যে শুটকি পল্লী ছিল, তার একটি অংশ সৈকতের পশ্চিম দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখানে আগে প্রায় ২০ ব্যবসায়ীর বাসা ছিল। কিন্তু এখন এই বাসার সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর রয়েছে ১০-১২ জন করে শ্রমিক। ব্যবসায়ী আর শ্রমিকেরা নানামুখী সংকটের কথা জানালেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, ব্যবসায়ীরা আট-১০ লাখ টাকা পূঁজি নিয়ে শুটকি ব্যবসায় নামেন। মাছ শুকানোর জন্য বাঁশের মাঁচা তৈরি করতে হয়। কিনতে হয় জাল-নৌকা। এর ওপর রয়েছে বাসা তৈরি আর জেলেদের দাদন বাবদ পূঁজি। আগে এই পূঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা অনেক লাভবান হতেন। কিন্তু লোকসানের ভয়টাই বেশি।
সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন আদি বাসিন্দারা জানালেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে কুয়াকাটায় শুটকির ব্যবসা চলে আসছে। পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার আগে এখানে অনেক বড় শুটকি পল্লী ছিল। ব্যবসা বানিজ্য ছিল ভালো। কিন্তু সেই জমজমাট শুটকি উৎপাদনের ধারা এখন আর নেই। মূল সৈকত থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর সৈকতের পশ্চিম দিকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি পল্লী গড়ে ওঠে। সেখান থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে লেম্ফুর চরে কয়েক ব্যবসায়ী মিলে আরেক পল্লী গড়েছেন। অনেকে আবার মহিপুর ইউনিয়নের খালগোড়ায় ছোট্ট শুটকি পল্লী তৈরি করেছেন। যে যেভাবে পারছেন, ব্যবসা টিকিয়ে রেখে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শুটকি পল্লীর জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। প্রতিবছর নতুন নতুন স্থানে পল্লী করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় বাড়ে লোকসানের পরিমাণ।
শুটকি উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ীভাবে সরকারি উদ্যোগে শুটকি পল্লীর জন্য জায়গা নির্ধারণ, শুটকি বিক্রির জন্য টলশেডসহ বাজার তৈরি করা ও ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করা। তারা বলেছেন, এইসব উদ্যোগ নেওয়া না হলে কুয়াকাটা থেকে এক সময় শুটকি ব্যবসা হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে কুয়াকাটা পৌর কর্তৃপক্ষ বলেছে, শুটকি ব্যসায়ীদের নিজস্ব পল্লী ও শুটকি বিক্রির নির্দিষ্ট বাজার তৈরি করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪