রাজশাহী: পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম সূর্যের আলোয় লালচে আকাশ। সেই আকাশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে একঝাক পাখির ছুটে চলা।
এ যেনো প্রকৃতির এক নৈসর্গিক পাওয়া। যার সবকিছুই রাজশাহীর পুঠিয়ার হামিদ মাস্টারের আমবাগানকে ঘিরে।
হ্যাঁ, হামিদ মাস্টারের আমবাগানই এখন অতিথি পাখিদের ‘আপন’ ঠিকানা। এ শীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বছর ঘুরে অতিথি পাখিরা আসে এখানে।
প্রাচীন স্থাপত্যে গড়া রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভালুকগাছী গ্রামে বসত গড়েছে ভিন দেশি পাখিরা। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এখানেই তাদের বসবাস। আর এ পাখিদের নিয়েই হামিদ মাস্টারের সংসার। পাখিগুলো যেনো তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মতই আপন। তাই মোটেও অকৃতজ্ঞ নয় পাখিরা।
এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিদান দিতে নিজেদের ঠিকানা ভুলে থেকে গেছে হামিদ মাস্টারের সাথেই। শুনতে অবাক লাগলেও একথা সত্য যে, পাখিগুলো তার বাগান ছাড়া অন্য কোন গাছে বসে না।
গ্রামের পর গ্রাম। গাছ-গাছালি আর আমবাগানেরও শেষ নেই। কিন্তু দূর-দূরান্ত ঘুরে এসে ওই বাগানেই পাখিদের বসবাস। তাই এরই মধ্যে আমবাগনটি রাজশাহীসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের সব চেয়ে বড় অতিথি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। পুরো গ্রামের লোকজনই এখন তাদের পাহারাদার।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন পাখি দেখতে ও তাদের কলতান শুনতে। পুরো আম বাগানজুড়ে বসেছে ধবধবে সাদাসহ হরেক রঙের অতিথি পাখির মেলা।
স্কুল শিক্ষক আবদুল হামিদের ছেলে রাজশাহী সরকারি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র রিপন শেখ বাংলানিউজকে জানান, তাদের বাগানের আয়তন এক একর। সাত বছর ধরে পাখিরা থাকছে এখানে। তাদের কারণে এত বড় বাগানে একটি আমও ধরেনা। কিন্তু তাতেও দুঃখ নেই।
তিনি আরও বলেন, বিগত দিনের চেয়ে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। বাগানের গাছে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পাখিরা এখন তাদের বাড়ির আঙ্গিনার আমগাছ, নিমগাছ, বেলগাছসহ সব গাছে বসছে। তার পরেও তারা অন্য কোনো মানুষের গাছে বসেনি। শুধু তাদের গাছেই পাখি বসে কেন? এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনাও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘ভালোবাসা’র কথাই বলেন সবাই।
এরই মধ্যে খবর পেয়ে বেশ কয়েকবার এলাকটি পরিদর্শন করছেন, রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোল্যা রেজাউল করিম। এখনও নিয়িমিত খোঁজ-খবর রাখেন তিনি।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোল্যা রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, পুঠিয়ার ভালুকগাছি গ্রামের আবদুল হামিদ মাস্টারের পুরো এলাকাকে ‘পাখিদের অভয়াশ্রম সংরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষিত এলাকার সাইন বোর্ডও স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া বন্যপ্রাণী বিভাগের উদ্যোগে আবদুল হামিদকে একটি ক্যামেরা দেওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে একজন সার্বক্ষনিক ওয়াচার (পর্যবেক্ষক)। এলাকায় পাখি শিকার নিষিদ্ধ করে মাঝে মধ্যেই মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া সচেতন করতে পর্যটকদের মধ্যে লিফলেটও বিতরণ করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে এগুলো অতিথি পাখি নয়। এসব পাখিকে অতিথিপরায়ণ মানুষ আদর করে নাম দিয়েছে অতিথি পাখি। নিজের দেশ বা এলাকা ছেড়ে বিশেষ প্রয়োজনে আসে এবং কিছুদিন পর ফিরে যায়। এদের সাধারণত পরিযায়ী পাখি বলে। পৃথিবীতে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখি আছে। এসব পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে আসে।
তবে এ পাখিগুলো যাচ্ছেনা কেনো তা না বলতে পারলেও তিনি জানিয়েছেন, শামুখখোল জাতের পাখিই এখানে বেশি রয়েছে। এছাড়া হিরন, পানকৌড়ি জাতের পাখিও এখানে রয়েছে জানান তিনি।
কথা হয় ওই আমবাগানের মালিক পাখি প্রেমী আবদুল হামিদ মাস্টারের সাথে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত সাত বছর থেকে পাখিরা আমার পুরো এলাকাজুড়ে বসবাস করছে। তারা এখন আমার পরিবারের সদস্যের মতই। পাখি শিকার না করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুইটি সাইন বোর্ড দিয়েছিলেন। ওই সাইনবোর্ড আনতে গিয়ে মাজার হাড় ভেঙেছে। আমি তাই ঘড়েই থাকি।
তিনি জানান, ‘বাগানে পাখি বসবাস করায় আম মৌসুমে গাছে কীটনাশক স্প্রে করতে পারিনা। এজন্য আমও ধরেনা। এতে বছরে আমার প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। অনেক লোকজন বলেছে, পাখিদের তাড়িয়ে দেও, কিন্তু আমি পাখিদের ভালোবেসে ফেলায় আজও তা করতে পারিনি। ’
এ সময় তিনি তার পাখিশ্রমটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
বাংলাদেশ সময় : ০১৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৪