সুন্দরবনের করমজল থেকে ফিরে: সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে। পশুর নদীর পাশে গড়ে তোলা সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের এই প্রজনন কেন্দ্রের চৌবাচ্চায় নদী থেকে পানি তুলতে হয়।
জোয়ার ভাটার টানে ও বনবিভাগের তেল অপসারণ অভিযানের কারণে নদীর পানি তেলমুক্ত হওয়ায় সোমবার আবারও আগের মতো প্রজনন কেন্দ্রে নদীর পানি তোলা সম্ভব হয়েছে বলে মঙ্গলবার বাংলানিউজকে জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুর রব।
তিনি জানান, প্রজনন কেন্দ্রে নতুন করে পানি তুলতে পারায় স্বস্তি বিরাজ করছে।
২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে আট একর জমির ওপর বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি কুমির নিয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়।
৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগমারী নামক স্থানে নোঙরকৃত একটি তেলবাহী ট্যাংকারকে এমটি টোটাল নামক একটি জাহাজ আঘাত করলে তলদেশ ফেটে গিয়ে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুর রব বলেন, ট্যাঙ্কার ডুবির প্রভাব করমজলের কুমিরের উপরও পড়েছিলো। ঘটনার দিন দুপুরে পশুর নদীতে জোয়ারের পানি এলে লবণ পানির কুমিরের চৌবাচ্চাগুলোর পানি পরিবর্তন করি। ওই জোয়ারের পানিতে যে তেল ভেসে আসে, তাও চৌবাচ্চায় উঠে এসেছিল। তা দেখে ওই দিনের পর আর পশুর নদীর পানি চৌবাচ্চায় তোলা হয়নি।
তরপরও আগস্ট মাসে জন্ম নেওয়া সাতটি ছানার মুখে ঘা দেখা দেয়। চিকিৎসা দেওয়ার পর তারা সুস্থ হয়েছে। তেল মিশ্রিত পানি পান করার কারণেই এই কুমির ছানাগুলো আক্রান্ত হয়েছিলো।
তিনি জানান, ২৪ ঘণ্টা পর পর প্রজনন কেন্দ্রের পানি পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু ঘটনার দিন থেকে সোমবার পর্যন্ত পানি বদলানো যায়নি। পানি পরিবর্তন করতে না পারার ফলে কুমির ছানাগুলোকে মলমূত্রের মধ্যে বসবাস করতে হয়েছে। হরিণ ও বানরকে পানির কষ্ট করতে হয়েছে।
আব্দুর রব বলেন, লবণ পানির প্রজাতির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য সুন্দরবনস বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় এ কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ১৮টি চৌবাচ্চায় চার মাস থেকে ছয় বছর বয়সী মোট ২৫৫টি লবণ পানির কুমির, ৪৬টি হরিণ, ৩টি বানর, করমজল ঘাটেই সুন্দরবনের একটি মানচিত্র (এই মানচিত্রে একনজরে সুন্দরবনকে দেখা যায়), বাঘ-হরিণের কঙ্কাল, কুমিরের নমুনা ডিম, কুমিরের মাথাসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন নমুনা রয়েছে বলে তিনি জানান। এ পর্যন্ত এখানকার কুমির ৫৭৪টি ডিম দিয়েছে। যার মধ্যে ৩৫৭টি বাচ্চা হয়েছে। এখান থেকে ৮৭টি কুমির বনে ছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পার্কে কুমির সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি জানান, করমজলে কাঠের তৈরি টাওয়ার আছে। যেখানে উঠে সুন্দরবনের বিশাল এলাকা সহজে দেখা যায়।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই কেন্দ্রটি তত্ত্বাবধান করা এ কুমির বিশেষঞ্জ বলেন, কুমিরদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বই লিখেছি। যার নাম- crocodiliam and bangladesh|
এদিকে জোয়ার-ভাটার টানে সুন্দরবনের নদী-নালা-খালে যাতে তেল আরো ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য বাঁশ, কাঠ ও পলিব্যাগ ব্যবহার করে বুম (পানির ওপর ভাসমান বাঁধ) তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীতে ভাসমান উদ্ভিদ এবং তীরে গাছের গোড়া, পাতা ও কাণ্ডে লেগে থাকা তেল অপসারণে সোমবার থেকে তিনটি পাম্প মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। নৌকায় মেশিন বসিয়ে নদী থেকে পানি তুলে মোটা পাইপ দিয়ে তা গাছপালার গায়ে ছিটিয়ে তেল পরিষ্কারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অন্য জায়গা থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে জোয়ারের সময় সেগুলো শ্যালা নদীসংলগ্ন খাল-নালায় ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পরে ভাটি থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাছগাছালির গোড়া এবং নদীতীরে লেগে থাকা তেল মুছে নিয়ে ভাটিতে নামছে কচুরিপানাগুলো। সব মিলিয়ে তেলে বিবর্ণ সুন্দরবনে প্রাণ ফেরাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন স্থানীয় ২শ’ মানুষ ১শ’ নৌকা নিয়ে।
সুন্দরবনের নদীতে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে ছড়িয়ে পড়া তেল কিনছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪