বাগেরহাট: বিশ্বে সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ বাঘের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ। তবে, চলতি শুমারির ফলাফলে সুন্দরবনের এ অংশে বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা জানতে ২০১৩ সাল থেকে দুই ভাগে শুরু হয় বাঘশুমারি। বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ প্রকল্প বিষয়ক আঞ্চলিক সহযোগিতায় ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলমান এ শুমারির ফলাফল জানা যাবে জুন মাসে।
মার্চের শেষ হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতিতে বাঘের ছবি সংগ্রহের কাজ। এর পরই বিচার-বিশ্লেষণ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ঘোষণা করা হবে।
এরই মধ্যে ভারতীয় অংশে ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে বাঘ গণনার কাজ শেষ হয়েছে। এতে ২০০৪ সালের তুলনায় দেশটির সুন্দরবন অংশে বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
এ ফলাফলের আলোকে বাংলাদেশে গণনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ অংশেও বাঘে সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমবে বলে মনে হচ্ছে। এ অংশের সুন্দরবনে কমবেশি দুইশ’র মতো বাঘ থাকতে পারে। সে হিসাবে বাঘের সংখ্যা নেমে আসবে অর্ধেকের কমে।
শুধু গণনার প্রদ্ধতিগত কারণে নয়, প্রতিনিয়িত পাচারকারীদের দ্বারা বাঘ হত্যার কারণেও বাঘের সংখ্যা কমছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
বণ্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুল কবির জানান, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকায় ‘পায়ের ছাপ’ হিসাব করে বাঘের গণনা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় না। পরবর্তীতে ভারত ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতি গণনা শুরু করে। পরে বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে গণনায় সংখ্যা আগের তুলনায় কমে আসছে।
তিনি জানান, ভারতের সুন্দরবন অংশে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে গণনা শেষ হয়েছে। ‘পায়ের ছাপ’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ অংশে যখন বাঘ ছিল ৪৪০, তখন ভারত অংশে দেখা গেছে ২৭০। আর ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে এখন ভারতে ৭৬টি বাঘ পাওয়া গেছে।
পদ্ধতিগত কারণে বাঘের সংখ্যা এতো কম। সে হিসেবে বাংলাদেশেও বাঘের সংখ্যা কমে আসা স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশে বাঘ হত্যার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না, বলে মনে করেন ওই বন কর্মকর্তা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সুন্দরবন রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান সরদার সফিউল আলম মনে করেন, শুমারির পদ্ধতিগত কারণেই শুধু নয়, প্রতিনিয়ত বাঘ হত্যার কারণেও বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে ‘পায়ের ছাপ’ পদ্ধতির চেয়ে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ প্রদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনেক বেশি।
তিনি বলেন, বাঘ এখন বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় প্রাণি। কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসেন চৌধুরি বাংলানিউজকে জানান, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পূর্ব বন এলাকায় চোরা শিকারীদের দ্বারা হত্যার শিকার নয়টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছেন। যে পরিমাণ হত্যার ঘটনা ঘটছে, তার তুলনায় কমই ধরা পড়ছে।
তিনি বলেন, যে চামড়াগুলো পাচার হচ্ছে, সেগুলোর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ধার হওয়া চামড়ার হিসাব রাখা হচ্ছে। বাঘ হত্যার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় বলেও মনে করেন তিনি।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালি এলাকায় মৎস আহরণকারী কয়েক জেলে জানান, সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় আগে বাঘ দেখা গেলেও এখন তেমন একটা দেখা যায় না। বনদস্যুরাও এখন বাঘ হত্যা করছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
বাঘ হত্যায় বনদস্যুদের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন নি জাহিদুল কবিরও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনে বাঘ হত্যায় তৎপর আছে বড় ছয়টি শিকারী দল। তারা সুযোগ পেলেই বাঘ হত্যা করে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন দেশে পাচার করে। পশ্চিম বন বিভাগে শিকারীরা বেশি তৎপর।
সম্প্রতি সময়ে সুন্দরবন সংলগ্ন দুই জেলা থেকে থেকে র্যাব তিনটি বাঘের চামড়াসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার করেছে। তবে, এ পর্যন্ত শিকারীদের হাতে কতটি বাঘ মারা পড়েছে তার হিসাব বন বিভাগের কাছে নেই।
বনবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে এ পর্যন্ত চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনের ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তিন পরিস্থিতিতে বাঘ লোকালয়ে এসে হত্যার শিকার হয়। পশ্চিম বন বিভাগে বাঘ লোকালয়ে আসার ঘটনা বেশি ঘটে। প্রথমত, বাঘ যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় খাবারের অভাব। দ্বিতীয়ত, দুই আড়াই বছর বয়সে বাঘ তার মা কে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়। এ সময় বাঘ তার নিজস্ব জায়গা নির্ধারণ করার জন্য এলাকা খুঁজতে খুঁজতে বনের বাইরে আসতে পারে। তৃতীয়ত, বৃদ্ধ হয়ে গেলে বা অসুস্থ হলে বাঘ তার নিজ এলাকা হারিয়ে ফেলে। আরেকটি বাঘ তার এলাকা দখল করে নেয়। তখন ওই বাঘ সহজেই খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে।
প্রথম ধাপে গণনা ২০১৪ সালের এপ্রিলে শেষ হলেও সে সময়ে পাওয়া বাঘের সংখ্যা জানানো হয় নি। প্রথম ধাপের গণনায় দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দুই ব্লকে ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রাথমিকভাবে কতটি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে জানতে চাইলে জাহিদুল কবির বলেন, ‘সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। কিন্তু আমরা অনুমতি ছাড়া দিতে পারবো না’।
বনবিভাগের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক অসীম মল্লিক বাংলানিউজকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ের বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণির বেশ কিছু চামড়া উদ্ধার হয়েছে। সুন্দরবনে বাঘ গণনা চলছে। পুরো ফলাফল পাওয়ার জন্য আরো একটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে, বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং এমন পাচারের ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।
তিনি বলেন, বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে শুধু পাচারকারীরাই দায়ী তা নয়। সুন্দরবনের সম্পদের ওপর মানুষের চাপও এখন অনেক বেশি। এটিও বন্যপ্রাণি এবং সম্পদের জন্য হুমকি।
তিনি বলেন, বন বিভাগের লোকবল খুব কম। সুন্দরবনের একেকটি বড় এলাকার কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাহারা দিচ্ছে একজন বনকর্মী। যদি লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া না হয়, তবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা খুব কঠিন হবে।
বনবিভাগের নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এতো বড় সম্পদ পাহারা দিতে আরো বেশি জনবল ও শক্তিশালী বাহিনী দরকার। জনবল এবং সামর্থ বাড়ানো না গেলে সুন্দরবন রক্ষায় বনবিভাগের পক্ষে সঠিকভাবে কাজ করা কঠিন বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রক্ষক। বাঘ কমলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের ওপর হুমকি বাড়বে। তাই শুধু বাঘ নয় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে রক্ষায় এবং সকল জীববৈচিত্র রক্ষায় আরো উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। আর তা না হলে বিপন্ন হবে বাংলাদের গৌরব বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণি হিসেবে ঘোষণা করে।
একাধিক সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৪৫৩টি বাঘ ছিল। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৪০টি। তবে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ৩৬৯টি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৫