ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

বন্যার পানি যখন যুদ্ধের অস্ত্র

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫
বন্যার পানি যখন যুদ্ধের অস্ত্র

ঢাকা: ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দটা শুনলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। কেবল তাই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্যার খবর শুনলেই নড়েচড়ে বসেন সবাই।



এক বা একাধিক এলাকা ভেসে যাচ্ছে বানের জলে, বাড়িঘরগুলো হয়ে উঠেছে ছোট ছোট দ্বীপ, স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে মানুষ-গবাদি পশু, হতাহতের ঘটনা ঘটছে প্রতিমুহূর্তে।

খাবার ও চিকিৎসা সংকট, মহামারীর কারণে সমান হারে অসুস্থ হয়ে মারা পড়ছে মানুষ-পশু। অন্য এলাকার মানুষ তখন খবরের কাগজ উল্টায়, চোখ রাখে টেলিভিশনের পর্দায়।

অথচ এ বন্যাকেই একসময় মানুষ ব্যবহার করেছে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে। শুনতে অবাক লাগলেও ইতিহাসের পাতা উল্টালে সহজেই খুঁজে পাবেন সে তথ্য।

বিভিন্ন মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্রের কথা মানুষ বহুকাল ধরেই শুনে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলই নির্ধারণ করে দিয়েছিল হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে নিক্ষিপ্ত অ্যাটম বোমা। এছাড়া আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল, ট্যাংকসহ আরও অস্ত্র তো রয়েছেই। এতো এতো অস্ত্রকে পাশ কাটিয়ে বন্যার পানিকেও যুদ্ধাস্ত্র হয়ে ওঠার শক্ত প্রমাণ হাজির করেছেন গবেষকরা।

চলতি বছর জুনের প্রথমদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি জার্নালে ‘নদীর মুখে বন্যা: মনুষ্য কারণ অথবা প্রাকৃতিক কারণ?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

নেদারল্যান্ডের আমস্টার্ডামে অবস্থিত ভিইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক দে ক্র্যাকারের নেতৃত্বে একদল গবেষক নেদারল্যান্ড ও এর আশেপাশের অঞ্চলে গত পাঁচ শতকে সৃষ্ট বন্যাগুলো, এগুলোর কারণ ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এতে নেদারল্যান্ড যুদ্ধের কথা, দ্বিতীয় যুদ্ধের কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রমাণ হিসেবে।

ষোড়শ শতকের শুরু থেকেই স্বাধীনতার জন্য নেদারল্যান্ডে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোষ্ঠী বিদ্রোহও করে বসে। স্পেনের শাসন থেকে মুক্ত হতে ১৫৬৮ সালে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ স্থায়ী হয় ১৬১৮ সাল পর্যন্ত। আর ১৬১৮ সাল থেকে সার্বিক ইউরোপীয় যুদ্ধে জড়িয়ে নেদারল্যান্ড ও স্পেনের লড়াই চলে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত।

‘এইটি ইয়ার্স ওয়ার’ নামে এই যুদ্ধ ইতিহাসে পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। তবে ইউরোপ যুদ্ধের কারণে শেষ ত্রিশ বছরের যুদ্ধকে ‘থার্টি ইয়ার্স ওয়ার’ নামে আলাদাভাবেও অভিহিত করে থাকেন ইতিহাসবিদরা।

এই যুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র ছিল বন্যা। ডাচ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উইলিয়াম। স্পেন সেনাদের প্রবল আক্রমণ প্রতিহত করতে ও দেশকে স্বাধীন করতে তিনি এক অভিনব পরিকল্পনা করলেন। দেশের নিম্নাঞ্চলকে তিনি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন। বেলজিয়ামের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ব্রুশ ও নেদারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় এন্টওয়ার্প এলাকায় সমুদ্রের তীরবর্তী বাঁধ ধ্বংস করে দিলেন তিনি। ১৫৮৪ সাল থেকে ১৫৮৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময় তিনি এ কাণ্ড করে বসলেন। ফলাফল হলো অভাবনীয়। স্পেন সেনাদের অবস্থান আর নেদারল্যান্ডের মধ্যে যেন সীমানা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেল বন্যা। এরপর পাঁচ দশক চেষ্টা করেও স্পেন সেনারা আর নেদারল্যান্ডে কামড় বসাতে পারেনি।

তবে এ বন্যার প্রতিক্রিয়া এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্র্যাকার তার প্রতিবেদনে জানান, বন্যার ফলে পরিস্থিতি সম্পূণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। নেদারল্যান্ডের নিম্নাঞ্চলগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ জলে ডুবে রইলো পাঁচ দশক।

ক্র্যাকার এ বিষয়ে বলেন, কোনো এলাকা দীর্ঘদিন বন্যা কবলিত থাকলে প্রাণহানি, মানুষের আবাস থেকে আয় পর্যন্ত সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, আক্রান্ত এলাকায় ভূমিক্ষয় ও স্থানচ্যূতি, নতুন জলপ্রবাহ সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটে। নেদারল্যান্ডেও ব্যতিক্রম হয়নি।

যুদ্ধে শেষে যখন বন্যার পানি নেমে গেল, আক্রান্ত এলাকার ভূমিতে,  স্থাপনাগুলোয় তখন পলির আস্তরন পড়ে গেছে। তার সঙ্গে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে মাটির লবণাক্ততাও বেড়ে গেছে অনেক গুণ। ফলে বসতবাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছুই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। সে সময় মানুষের একমাত্র জীবিকা কৃষিও হয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ক্র্যাকার বলেন, এভাবে বন্যা সৃষ্টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি যুদ্ধকৌশল। এটা তখনই সফল হতে পারে, যখন বিকল্প ও দ্রুত ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার কোনো পরিকল্পনা থাকে। তবে নেদারল্যান্ডের সে যুদ্ধে বিকল্প কিংবা ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার কোনো পরিকল্পনার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

এ তো গেল একটা বন্যার ঘটনা! ক্র্যাকার ও তার দলের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। ষোড়শ শতকে নেদারল্যান্ডের ওই ব্যাপক বন্যার আগে যতো বন্যা হয়েছে, সবগুলোই ছিল প্রাকৃতিক কারণে। এগুলোর বেশিরভাগই ঝড়-বৃষ্টির কারণে হয়েছে। আর পরের বন্যাগুলো হয়েছে মানুষের কারণে।

ক্র্যাকার দেখিয়েছেন, নেদারল্যান্ড ও তার আশেপাশের অঞ্চলে প্রাকৃতিক কারণে বন্যা হয়েছে ২১ বার। আর যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষ সৃষ্ট বন্যার সংখ্যা ছিল মোট ১১টি। তবে প্রাকৃতিক কারণে যে বন্যাগুলো হয়েছিল, সেগুলোতেও মানুষের দায় ছিল।

ক্র্যাকারের গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে, বিংশ শতাব্দিতে চল্লিশের দশকে বন্যা আবারও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, বন্যার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তিকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলে সম্ভব হয়েছিল। আর মিত্রশক্তি হয়ে উঠেছিল আক্রমণাত্মক।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৫
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।