ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

আন্তর্জাতিক পানি দিবস

নোংরা ছড়ার পানিই ভরসা চা শ্রমিকদের

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, এনভায়রনমেন্ট স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
নোংরা ছড়ার পানিই ভরসা চা শ্রমিকদের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): অনিরাপদ ছড়ার পানি আজও একমাত্র ভরসা শ্রীমঙ্গলের জাগছড়া চা বাগানের চা শ্রমিকদের। যে ছড়ার পানিতে গোসল ও কাপড়-চোপড় কাচেন সেই পানিতেই চলে রান্নাবান্না ও থালাবাসন ধোয়ার কাজ।

শুধু তাই নয় একই ছড়ার পানিই পান করতে হয় এসব চা শ্রমিকদের। একদিন-দু’দিন নয়, বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এভাবেই!
 
আন্তর্জাতিক পানি দিবসে মঙ্গলবার (২২ মার্চ) দুপুরে জাগছড়া চা বাগান এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে এসব দৃশ্যই চোখে পড়ে! তবে চা শ্রমিকদের কাছে এ যেন অতি সাধারণ ব্যাপার। নোংরা পানি ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে একেবারেই সচেতন নন তারা।  

তবে তিন তরুণ- পরিমল নায়েক, কেশব কানু ও বিপুল নায়েক স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের পরিজনদের দুর্ভোগের কথা বলে যাচ্ছেন। সম্মিলিত স্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই তিন তরুণ বলেন, ‘বাগান কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা লাভ করলেও শ্রমিকরা আজও নিত্যদিন ছড়ার অনিরাপদ পানিই ব্যবহার করছেন। ’
 
জাগছড়া চা বাগান ফিনলে চা কোম্পানির একমাত্র চা বাগান যেখানে ‘গ্রিন-টি’ তৈরি হয়। প্রতি কেজি গ্রিন-টি’র মূল্য সাড়ে ৬শ’ টাকা। ব্লেক-টি থেকে গ্রিন-টি’র চাহিদা ও উপকারিতা বেশি।

সূর্য তখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মধ্য আকাশ দখল করে নিয়েছে। অনেকগুলো খণ্ড-খণ্ড টিলা অতিক্রম করে জাগছড়া চা বাগানের উপরটিলার সেই প্রবহমান জলাশয়ের ধারে পৌঁছানো গেলো।

প্রবেশমুখেই দেখা যায় সেই বিচিত্র দৃশ্য! গোসল, কাপড় ধোয়া ও রান্নার পানি সংগ্রহ করছেন শ্রমিকরা। জলাশয়ের মোট ৫টি স্থানে ঘাট তৈরি করে চা শ্রমিকরা পানি ব্যবহার করছেন দিনের পর দিন।

ছড়াটির স্থানীয় নাম ‘চুয়া গাঙ’। জাগছড়াটি-ই মূলত এঁকেবেঁকে হাইল হাওরে গিয়ে পতিত হয়েছে। আর চলার পথে টিলার গায়ে গায়ে বসত করা অভাবী মানুষদের জলের অভাব পূরণ করে চলেছে।  

সর্দার সুভাষ কানু জানালেন, এই বড়টিলা লাইনে পানির সমস্যা নিত্যদিনের ঘটনা। এখানে চা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। টিউবওয়েল রয়েছে মাত্র ছয়-সাতটি। তাহলে পানির চাহিদা কী করে মিটবে?

চুয়া গাঙের দ্বিতীয় ঘাটে গিয়ে চোখে পড়লো এক মহিলা বসে বসে হেঁটে চলেছেন। তিনি দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারেন না। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, পদ্মা তাঁতি। তার সাথে রয়েছে তার সাত বছরের পুত্রসন্তান।
 
কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, পদ্ম তাঁতি প্রতিদিন তিন-চারবার করে প্রায় দুশ’ গজ দূর থেকে বহু কষ্ট করে পানি নিতে আসেন এই ছড়ায়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না বলে সময় অনেকক্ষণ লেগে যায়। বেলা বাড়ে! কিন্তু সঞ্চয় আর বাড়ে না!  
 
‘আমরা গরিব। আমাদের কথা কে আর ভাবে বাবু?’ – তামাটে মুখমণ্ডল জুড়ে এমনই অভিমান তার!
 
সবিতা তাঁতি, জয়া নায়েক এবং তৃষ্ণা তাঁতি বাংলানিউজকে জানান, ‌‌আমাদের শ্রমিক লাইনে পর্যাপ্ত টিউবওয়েল নেই। যেগুলো আছে তার জন্য লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। কোনো কোনোটাতে আবার পানি পড়ে না।   
 
নয়নী নায়েক বলেন, ‘আমি বহু দূর থেকে এই ছড়ায় পানি নিতে আসি। এই পানি দিয়ে কাপড় ধুই, থালা-বাসন ধুই আর রান্না করি। ’
 
নয়নমণি, সীমা তাঁতি এবং অঞ্জনা নায়েক জানান, বৃষ্টি বেশি হলে তাদের খুব কষ্ট হয়। ছড়ার পানি ভরে যায়। আমরা ব্যবহার করতে পারি না।  
 
‘যারা দূরের বন থেকে জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করে আনেন, তাদের একটু পানীয় জলের ভীষণ প্রয়োজন হয়। দূরের ছড়া বা টিউবওয়েলের একটু পানির জন্য প্রাণটা ছটপট করতে থাকে তখন। ’ - জানালেন বিপুল নায়েক।  
 
বাসন্তী কালেন্দি, মিলা কাহার এবং হন্তিনা তাঁতি আক্ষেপের সুরে জানান, যারা ব্যক্তিগতভাবে নিজের বাড়িতে টিউবওয়েল বসিয়েছেন তারা অন্যদের পানি নিতে দেন না। তাই ছড়ার পানিই তাদের ভরসা।
 
টিলার একেবারে উঁচুতে সরস্বতী কানুরা থাকেন। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে চার-পাঁচ বছর আগে টিউবওয়েল বসিয়েছেন নিজেদের বাড়িতে। তিনি জানালেন, ১৩০ ফুট এর গভীরতা। এখন অল্প অল্প পানি পড়ে। নিজেদেরই চাহিদা মেটে না এই পানিতে।  
 
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক নেতা রামভজন কৈরি বাংলানিউজকে বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের এখনও যথাযথ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রেও শ্রমিকদের নিরাপদ পানীয় জলের কোনো সুব্যবস্থা নেই। পানি পানের পাত্র ছাড়াই শ্রমিকরা নিজের হাত দিয়ে ঝরনা ও ছড়ার পানি পান করে থাকেন।   

মৌলভীবাজার সদরের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বিনেন্দু ভৌমিক বাংলানিউজকে বলেন, পানিবাহিত রোগ যেমন দীর্ঘমেয়াদী ডায়েরিয়া, টাইফয়েড ফিভার, হেপাইটিস ‘এ’ ‘ই’, আমাশয় জাতীয় রোগ, ক্রিমির প্রকোপ এবং খাদ্যে বিষক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করে থাকে বলে চা বাগানের ছড়ার পানি ব্যবহার করা শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ।   
 
জাগছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবির মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, উপরটিলা এলাকাটি দুর্গম। পানির স্তর অপেক্ষাকৃত নিচে বলেই হয়তো টিউবওয়েল থেকে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। অচিরেই আরও কিছু টিউবওয়েল দেওয়ার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।
 
‘একটি টিউবওয়েল পেলে আমার জানটা বাঁচতো’ – ফিরে আসার সময় পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে না পারা পদ্মা তাঁতির আক্ষেপটাই মাথায় ঘুরছিল অনেকক্ষণ!

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
বিবিবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।