পর্যাপ্ত ফসলি জমি ও চারণভূমির অভাব ও বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে সারাবিশ্বেই মৌমাছির স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে মানসম্পন্ন মধু ও মোমের উৎপাদন বাড়াতে মৌ-রানির (রানি মৌমাছি) কৃত্রিম প্রজনন করা হয়।
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি মৌমাছির প্রজনন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতিতে মৌমাছির প্রাকৃতিক প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত দুরূহ। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের গবেষকরা কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে তাদের চাহিদা ও পছন্দমত রানি-মৌমাছি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো দেশে মধু উৎপাদনকারী মৌমাছির কলোনির সংখ্যা বাড়াতে অল্প সময়ে রানি মৌমাছির কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) একদল গবেষক। গবেষণাদলটির নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন। এ গবেষণায় আর্থিক সহায়তা করছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন।
কৃত্রিম প্রজননের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ড. সাখাওয়াৎ বাংলানিউজকে বলেন, প্রয়োজনীয় মৌ কলোনির অভাবে প্রায় পনের হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনযোগ্য মধু আমরা সংগ্রহ করতে পারি না। সেজন্য মৌ কলোনির সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে একমাত্র কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমেই উর্বর রানির সংখ্যা বাড়িয়ে মৌ-কলোনির সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। কারণ উর্বর রানি থেকেই পাওয়া যায় উর্বর মৌ-পুরুষ ও দক্ষ মৌ-কর্মী|
তিনি বলেন, রানি উৎপাদন সারাবছরেই করা যায়। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে রানির মিলন সারাবছরেই সফলতার সাথে সম্পন্ন হয় না। এতে উর্বর রানির সংখ্যা কমে যায়। উর্বর রানির জন্য প্রয়োজন উর্বর পুরুষ। একটি ভাল উর্বর রানি সফলভাবে সারাবছর ডিম দেওয়ার জন্য গড়ে বারোটির মত পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলিত হতে হয়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রানিগুলো দিন দিন ডিম দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এজন্য প্রয়োজন কৃত্রিম প্রজনন।
কৃত্রিম প্রজননের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. সাখাওয়াৎ বাংলানিউজকে বলেন, রাণীর প্রজনন ব্যবস্থা নির্ভর করে ড্রোন (মৌ-পুরুষ) মৌমাছি হতে প্রাপ্ত গুণগত মানসম্পন্ন শুক্রাণু, সুস্থ সবল নিরোগ রানি এবং অভিজ্ঞ প্রজননবিদের উপর। প্রাকৃতিকভাকে রানি মৌমাছি অসংখ্য পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলিত হবার ফলে এদের সুনির্দিষ্ট জিনোমিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে একটি পুরুষ মৌমাছিকে নির্দিষ্ট প্রজাতির উপর ভিত্তি করে আলাদা করা হয়। এর ফলে প্রজাতির বৈশিষ্ট্য রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, কৃত্রিম প্রজননের শুরুতে রানি মৌমাছিকে অচেতন করে চলনে অক্ষম করা হয়। পরে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রানি মৌমাছির স্টিং বা হুল চেয়ার উন্মুক্ত করা হয়। এরপর সিরিঞ্জ দিয়ে রানির ভেজাইনাল ওরিফিসে (যোনী-ছিদ্রে) সংগ্রহকৃত ড্রোনের সিমেন (শুক্রাণু) প্রবেশ করানো হয়। এই কৃত্রিম ব্যবস্থায় রানি ও ড্রোন উৎপাদনই মূল উদ্দেশ্য।
কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা সম্পর্কে গবেষকরা জানান, বর্তমান সময়ে রানি উৎপাদনের উত্তম উপায় হচ্ছে গ্রাফটিং পদ্ধতি। যেটি ২০১০ সালে গাজীপুরের একটি মৌখামারে সম্পাদিত হয়। গ্রাফটিং বা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এপিস মেলিফেরা (Apis melifera) প্রজাতির রানি মৌমাছির প্রজনন ঘটিয়ে সহজে এর সংখ্যা বাড়ানো যায়। কৃত্রিম উপায়ে জন্ম নেয়া রানি ৪-৫ বছর বেঁচে থাকে। এই পদ্ধতিতে সৃষ্ট কর্মী মৌমাছির মধু উৎপাদন প্রাকৃতিক উপায়ের চেয়ে ১.৫-২ গুণ বেশি। এ পদ্ধতিতে বর্ষাকালীন প্রজনন সমস্যা সহজেই দূর করা যায়।
চলমান এ গবেষণায় গ্রাফটিং পদ্ধতির পরিবর্তে নাইকো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে লার্ভার আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। এবং খুব কম সময়ে ২৪ ঘণ্টার চেয়ে কম বয়সী লার্ভা নির্বাচন করা যায়।
মৌমাছি গবেষক ড. সাখাওয়াৎ বলেন, প্রতিরোধী জাত নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে ‘ভেরোরা মাইট’ এর আক্রমণ থেকে মৌমাছি সুরক্ষা পায়। ‘ভেরোরা মাইট’ এক প্রকার পরজীবী যা মৌ-কলোনির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
গবেষকরা জানান, প্রচলিত বা সনাতন পদ্ধতিতে ৬-৭ মাস পর্যন্ত ডিম দিতে পারে এমন মৌ কলোনি ও রানি মৌমাছি নিয়েই আমাদের মৌ চাষীদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। নতুন করে আবার তাদের রানি উৎপাদন ও মৌচাক ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হয়। অন্যদিকে কৃত্রিম প্রজননকৃত রানি সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননকৃত একটি রানির আর্ন্তজাতিক বাজারমূল্য প্রায় ২৪০০ টাকা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে আমাদের দেশীয় আবহাওয়া-উপযোগী রানি উৎপাদন করতে পারলে বাঁচবে সময় ও অর্থ।
কৃত্রিম মৌপ্রজনন পদ্ধতিতে রানি মৌমাছির সংখ্যা যেমন বাড়ানো যায়, তেমনি প্রাকৃতিক উপায়ে মৌচাষকে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে দেশের মানুষ গ্রহণ করলে দেশের বেকার সমস্যা অনেকখানি দূর হবে। দেশেই কৃত্রিম উপায়ে উন্নতমানের রানি মৌমাছি উৎপাদিত হলে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রার।
বর্তমানে মৌমাছি চাষ সারা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারী সহযোগিতায় দেশে বেড়ে উঠছে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মৌচাষীরা গতানুগতিক গ্রাফটিং বা কলম ব্যবস্থায় কৃত্রিমভাবে রাণী উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। যা চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। চাষীদের দক্ষতার অভাবে কৃত্রিম প্রজনন ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মৌমাছি প্রজননকেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৮
জেএম