ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

কপোতাক্ষ নদে লোনা পানির অনুপ্রবেশ, চরম বিপর্যয়ের শঙ্কা!

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
কপোতাক্ষ নদে লোনা পানির অনুপ্রবেশ, চরম বিপর্যয়ের শঙ্কা!

সাতক্ষীরা: হঠাৎ করেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কপোতাক্ষ নদের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় কৃষি-প্রাণ বৈচিত্র্যে।

 

এরই মধ্যে সেচের পানির অভাবে ফসলের ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ঘনিয়ে আসছে বিপর্যয়। এরই মধ্যে পচতে শুরু করেছে কপোতাক্ষে জমাট বেধে থাকা কচুরিপানা।

স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও যশোর জেলার কেশবপুরসহ নদীর তীরবর্তী বসবাসরত হাজার হাজার পরিবারসহ কৃষি জমির সিংহভাগ পানির চাহিদা মেটে কপোতাক্ষ নদ থেকে। ৩০ দিন হলো কপোতাক্ষ নদে হঠাৎ করেই চিরায়ত ধারা পরিবর্তন করে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এতে সেচ সংকটে কপোতাক্ষের ওপর নির্ভরশীল মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। কৃষি কাজ, মিল, ছোটবড় কারখানা ও গবাদিপশু পালনে মিষ্টি পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।  

কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পাল বলেন, হঠাৎ নদীতে লোনা পানি আসায় তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পরিবার ও কৃষি কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকার মানুষ। কৃষি কাজে কপোতাক্ষ নদের পানি ব্যবহারে অভ্যস্ত কৃষকদের এখন চরম দুরাবস্থা।

স্থানীয় চাষি সুবির পাল বলেন, একদিকে অনাবৃষ্টিতে পুকুর জলাশয় গুলো শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলসহ সেচ কার্যে ব্যবহৃত মোটর ও স্যালোমেশিনে চাহিদা অনুযায়ী পানি পাওয়া যাচ্ছে না৷ কপোতাক্ষ নদীর পানি আগে সব কাজে সিংহভাগ ব্যবহার করলেও এখন নদীতে লোনা পানি আসায় কাজ ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে ইরি ধানের জমি ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। ধান ফোঁটার মুখে এমন পানি সংকটে কৃষকের চরম ক্ষতি হবে।

রিক্তা সরকার বলেন, আমরা নদীর তীরবর্তী বসবাস করায় কপোতাক্ষ নদের ওপরই ৯০ শতাংশ নির্ভরশীল৷ নদীতে লবণাক্ত পানি আসায় পশুপালন, নিজেদের গোসল, পরিবারের রান্নাসহ কোনো কাজ করেতে পারছি না৷ কচুরিপানা পচে পানি দিন দিন দুর্গন্ধ হয়ে উঠছে। লবণাক্ত পানি গরু-ছাগলকে খাওয়ালে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে৷

জয়নগরের ধান চাষি স্বরজিত দাস বলেন, নদীতে লোনা পানি এসে ইরি ধানসহ পাট, পানের বরজ ও সবজি আবাদে সেচ কাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ধানের ফলন বিঘাতে ২২-২৫ মণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যায়ে সেচের পানির অভাবে ধানের রোগ বালাইয়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। পানির নানামুখি সংকটের জন্য এখানকার কৃষদের চরম লোকসান গুণতে হতে পারে।

চাষি কার্তিক মুখ্যার্জী জানিয়েছেন, আড়াই বিঘা জমিতে সবজি আবাদ করেছি। নদীতে লোনা পানি আসায় সবজির জমিতে সেচ দিতে পারছি না। যার কারণে চাষকৃত তরকারির আবাদে ভালো ফলন পাচ্ছি না। প্রচণ্ড রোদের তাপে দুপুরে চারা নেতিয়ে পড়ছে৷

পান চাষি হারান ঘোষ বলেন, পানের বরজে সেচের অভাবে মাটি ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। লোনা পানি সেচের জন্য অনুপযোগী হওয়ায় বরজে সেচ দিতে পারছি না। কাট ফাঁটা রোদে পান ছোট হয়ে যাচ্ছে, পানের গাছও মারা যাচ্ছে।

কপোতাক্ষে লোনা পানি অনুপ্রবেশের বিষয়ে গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, জোয়ার ভাটার প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া ও নদীর তলদেহ ভরাট হওয়ার কারণে সমুদ্রের লোনা পানি অনেক বেশি অভ্যন্তরে চলে আসতে পারে। একইসঙ্গে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অশনি সংকেত নির্দেশ করে। এ মুহূর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিত হবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বিষয়টির তদন্ত করা। লোনা পানি প্রবেশের কারণে কৃষি ও মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে। বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে স্থানীয় কৃষি প্রাণ বৈচিত্র্যে। আমাদের নিজেদেরই রক্ষা করা কঠিন হবে। এ মুহূর্তে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক তহবিল ও তৎপরতা বাড়ানো। যাতে বৈশ্বিক তহবিল থেকে সাহায্য পাওয়া যায়।

এ তহবিল কপোতাক্ষ নদ পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, শুধুমাত্র তহবিল দ্বারা সম্ভব না, নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। আর লোকালি যেটা করা যেতে পারে, সেটা হলো উজান থেকে ভাটিতে কোনো ব্যারেজ না দেওয়া ও খনন করা, যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।