তখন স্বপ্নটা কেবল শুরু হয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলবেন, গায়ে জড়াবেন নীল জার্সি— অঙ্কিত বাওয়ানের জীবনে এটাই মূলমন্ত্র।
এরপর ওই বয়সে নিজেকে কীভাবে সামলেছেন? অঙ্কিত বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ভারতের হয়ে খেলা। ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল কখনোই ছিল না...। ’
জীবনে চড়াই-উতরাই কম আসেনি পরেও। রূপগঞ্জ টাইগার্সের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলার পর যখন তার সঙ্গে কথা হয়, অঙ্কিত বলেন শুরুতেই ‘এখানে এত গরম...’ তখন গরমটা অস্বাভাবিক ছিল, ব্যতিক্রমও; আশ্বস্ত করতেই অঙ্কিত জানান কীভাবে টিকে থাকতে হবে এখানে, ‘দৌড়াতে তো সবাই পারে, এখানে টিকে থাকতে শক্তি লাগবে!’ সেই শক্তির জন্য তার জীবনে আছে, ‘জিম আর যোগব্যায়াম। ’
কেবল ১৫ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক, এখনও মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সে অভিষিক্ত ক্রিকেটার। একশর বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন পরের ১৫ বছরে, তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে তখন নামের পাশে ১১০টা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ২১টা সেঞ্চুরি, ৩৪টা হাফ সেঞ্চুরিসহ ৫১.৬৯ গড়ে ৭ হাজার ৩৪১ রান। পরিসংখ্যানের এই সমৃদ্ধির পেছনের গল্প জানার আগ্রহটাই সবচেয়ে বেশি অঙ্কিতের কাছে। রঞ্জি আদতে কেমন? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এত লম্বা পরীক্ষাই বা দিলেন কীভাবে?
‘রঞ্জি খুবই কঠিন জায়গা। এটা সহজ না একদমই। যদি কেউ এই টুর্নামেন্টে পারফর্ম করে, তাহলে সে ভারতের হয়ে টেস্ট খেলতে তৈরি আছে। অনেক দল এখানে, সবগুলোই খুব ভালো। প্রতি বছর এখন রঞ্জিতে নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখা যায়, এটা দেখলেও বুঝবেন প্রতিদ্বন্দ্বীতাটা কেমন। ’
কিন্তু রঞ্জি কিংবা টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাও তো আছে। অঙ্কিত যখন তীব্র গরমে ঢাকার মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তখন তার দেশের আইপিএলে চলছে অর্থের ঝনঝনানি। দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে তিনিও একবার খেলেছিলেন, কিন্তু খুব বেশি লম্বা হয়নি ওই ক্যারিয়ার। হাতের মুঠোয় এত অর্থের হাতছানি, তবুও ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্ট কেমন?
অঙ্কিত বরং অনেক বেশি বাস্তববাদী, ‘দেখুন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আরও বেশি টাকা থাকা দরকার অবশ্যই। ভারতে বিশেষত, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অনেকটা টেস্ট খেলার মতোই ভালো। এটাতে আরও কিছু টাকা দরকার। কিন্তু একইসঙ্গে আমার এটাও মনে হয় খেলাটাকে ভালোবাসি বলেই আমরা ক্রিকেট খেলি। টাকার ব্যাপারে খুব বেশি ভেবে খেলি না। ’
‘আইপিএলে অনেক টাকা আছে সত্যি। কিন্তু ওটা একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট। মালিকরা টাকা দেয় ব্যক্তিগতভাবে, বিসিসিআই দেয় না। হিসাব কিছুটা আলাদা। কিন্তু আবারও বলবো, আপনি যে পর্যায়ে খেলছেন; খেলাটাকে ভালোবেসেই। টাকা উপার্জনের পথ আরও অনেক আছে। আপনি কিন্তু ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছেন। ’
ঢাকার জীবনে এমনিতে তার ভালোই লাগছে, বারবার কেবল গরমের অস্বস্তির কথা বললেন। সঙ্গে ওই আইপিএল না খেলার ‘আফসোস’টা একটু -আধটু বাড়ছে এখানে এসে। রাস্তায় হাঁটতে বের হলে অথবা হোটেলে; সবাইকে আইপিএলে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখেন। তবুও অঙ্কিতের মনে হয়, টিকে থাকতে হলে অথবা লম্বা রেসের ঘোড়া হতে দরকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটই।
‘‘যেকোনো দেশের জন্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। টেস্ট খেলতে হলে আপনাকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে হবে। ভারতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলাটা, ‘ইজ্জতওয়ালি চিজ (অনেক মর্যাদার ব্যাপার)’। সৌভাগ্যবশত আমি ১০০টা ম্যাচ খেলে ফেলেছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া উনি আমাকে এত কিছু দিয়েছেন। ’’
এই দীর্ঘ পথচলায় রান করেছেন। পৌঁছেছেন ভারতের ‘এ’ দল অবধি, দিয়েছেন নেতৃত্বও। তবুও জড়াতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সি। এতদিন ধরে স্বপ্ন না ছুঁয়ে শীর্ষ পর্যায়ে ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া তো মানসিকভাবেও খুব কঠিন কাজ? উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার পর অঙ্কিত শুনিয়েছেন রঞ্জিতে অনেক বছর আগে ধোনির সঙ্গে তার কথোপকথন। যা তাকে ‘চালিয়ে নিতে’ সাহায্য করে এখনও।
‘ধোনির সঙ্গে যখন আলাপ হলো আমাকে তখন বলেছেন— ভারতে সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন। কিন্তু কঠিন বলেই আশা ছাড়া যাবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে। ধোনির একটা কথা খুব মনে ধরেছিল তখন, যখন খেলাটা শুরু করেছি আমরা; কেউই ভাবিনি ভারতের অথবা রাজ্য দলের হয়ে খেলবো। আমিই তো কখনো ভাবিনি একশটি রঞ্জি ম্যাচ খেলবো। গলিতে ক্রিকেট খেলতাম খেলাটা ভালোবাসি বলেই। ’
ওই ভালোবাসা পরে বহু রঙে রাঙিয়েছেন নিজেকে। বন্ধু-বান্ধবদের চড়তে দেখেছেন সাফল্যের উঁচু সিঁড়িতে। বন্ধু মায়াঙ্ক আগারওয়ালকে প্রেরণা মানেন অঙ্কিত। মাঝেমধ্যে চান পরামর্শও। মায়াঙ্ক বলেন, ‘সবকিছু সরল রাখো, তোমার শক্তি অনুযায়ী খেলো, শেষ অবধি রান পাবেই। ’
অঙ্কিত সেটা মেনে নেন, এরপর বলেন নিজের ভাবনাও, ‘ভারতে যদি আপনি তিন ম্যাচ রান না করেন, বাদ পড়ে যাবেন। আপনি কত বড় ক্রিকেটার তাতে কিছু যায়-আসে না। আপনাকে রান করতেই হবে। এজন্য আমি সবসময় বর্তমানেই থাকতে চেয়েছি। ’
বছরের পর বছর ধরে রান করেছেন অঙ্কিত, প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চাশের বেশি আর লিস্ট-এ তে ৪৫ এর বেশি গড়ে। কীভাবে? অঙ্কিত জানালেন তাতে বড় ভূমিকা আছে বক্সিংয়ের। মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে জিম করেন নিয়মিতই, ক্রিকেটার না হলেও করতেন সেটি, বলেন তেমন। শারিরীক কসরত ক্রিকেটের কষ্টগুলো কমায় বলে বিশ্বাস অঙ্কিতের।
সকালে নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন এখন; যা ‘মাথা পরিষ্কার’ রাখতে সাহায্য করে । সঙ্গে আপন করে নিয়েছেন বক্সিংকেও, ক্রিকেটের সঙ্গে খেলাটার মিল খুঁজে পান বলেই দাবি তার।
‘বক্সিং আমি ভালোবাসি। কারণ এটা কুইক স্পোর্টস। আপনাকে দ্রুত পাঞ্চ করতে হবে, হাত কত তাড়াতাড়ি চলছে, কত শক্তি আছে আপনার, এসব জরুরি। বক্সিংয়ের মতো ক্রিকেটেও কবজির ব্যাপার আছে। বক্সিং তাই ব্যাটার হিসেবে আমাকে সাহায্য করে। আপনি যদি আজকেও আমার ব্যাটিং দেখেন, রিফ্লেক্স যা আছে আমার, বক্সিংয়ের জন্য। আমি অনেক লাফাই, জিম করি। আমি মনে করি শক্তিটা খুব জরুরি ক্রিকেটে। ’
শক্তি শরীরের সঙ্গে মনেও খুব দরকার বলে বিশ্বাস অঙ্কিতের। ‘রানমেশিন’ বিরাট কোহলি তার সামনে উদাহরণ। ভারতের ‘এ’ দলের হয়ে যখন খেলেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন রাহুল দ্রাবিড়কে। ক্রিকেটের ‘দ্য ওয়ালের’ কিছু ব্যাপার নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছেন। কী সেসব?
‘‘দ্রাবিড় স্যারের কাছে শিখেছি কীভাবে শান্ত থাকতে হয়, ধৈর্য ধরতে হয়, চাপের সময় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এসব ছোট ছোট বিষয় ক্রিকেটার হিসেবে আপনাকে বড় করে। দক্ষতা ও প্রতিভা সবার আছে। কিন্তু মানসিক দৃঢ়তা আপনাকে আলাদা মানুষ হিসেবে তৈরি করবে। রাহুল স্যার শুধু আমাকে না, পুরো দলকেই বলতেন, ‘প্রতিভা থাকাটা দারুণ। কিন্তু মানসিক দৃঢ়তা ও কঠোর পরিশ্রম তোমাকে পরের ধাপে নিয়ে যাবে। ’ এটা খুব ছোট কথা। কিন্তু খুবই সাহায্য করেছে আমাকে। ’’
বয়স প্রায় ৩০ হয়ে গেছে, জীবনের লম্বা একটা পথই পাড়ি দিয়ে এসেছেন। এখনও কি জাতীয় দলে খেলা সম্ভব? অঙ্কিত বলেন, ‘ভারতের টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়া এত সহজ না। বিরাট কোহলি, অজিঙ্কা রাহানে, চেতেশ্বর পূজারাদের আপনি আঙ্গুলের টোকায় সরাতে পারবেন না। আপনাকে বছরের পর বছর ধরে রান করে যেতে হবে। ’
এরপর অবশ্য অঙ্কিত শোনান স্বপ্নের কথাও, ‘আমি বিশ্বাস করি, এখনও আমার হাতে বয়স ও সময় আছে; যদি একটা-দুটো বড় রানের রঞ্জি মৌসুম পাই, তাহলেই সুযোগ আছে। ’ ক্রিকেট কিংবা জীবন— স্বপ্নবাজদেরই তো। অঙ্কিত তাই লড়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়েই এগিয়ে যেতে চান।
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৩
এমএইচবি/এএইচএস