ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

সাক্ষাৎকারে মহসিন শেখ/

‘কাউকে দোষ দেওয়া খুব সহজ’

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
‘কাউকে দোষ দেওয়া খুব সহজ’

যে ক্রিকেটারই তাকে দেখছেন, জড়িয়ে ধরছেন, কথা বলছেন; করছেন কুশল বিনিময়। মহসিন শেখ এবারের বিপিএলে কাজ করছেন খুলনা টাইগার্সের হয়ে; কিন্তু তিনি তারও আগে অ্যানালিস্ট, বাংলাদেশ জাতীয় দলের।

অল্প ক’দিনেই যে ক্রিকেটারদের ভরসা হয়ে উঠেছেন, প্রমাণ মিলছিল তারই।  

দ্বিতীয়বারের মতো বিপিএলে কাজ করা এই অ্যানালিস্ট সিলেটে মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলানিউজের।  শুনিয়েছেন কোচ থেকে তার অ্যানালিস্ট হওয়া, শেন ওয়ার্নের সঙ্গে হৃদ্যতার গল্প। কথা বলেছেন ‘তার ভুলে’ আফগানিস্তানের এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নেওয়া নিয়েও...   

বাংলানিউজ: বাংলাদেশে সময় কেমন কাটছে?

মহসিন: আমি বাংলাদেশে উপভোগ করছি। এখানকার খেলোয়াড়রা খুব ভালো। কিছু তরুণ ছেলে আছে, তাদের সঙ্গে কাজ করা উপভোগ করছি। গত বছর বিপিএলেও ছিলাম, এরপর নিউজিল্যান্ডেও ওদের সঙ্গে কাজ করেছি। বাংলাদেশে এলে ভালোই লাগে সবসময়।

বাংলানিউজ: একটু আগে দেখছিলাম নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে কথা বলছেন...

মহসিন: হ্যাঁ, ও নিউজিল্যান্ডে অধিনায়ক ছিল। উমরাহর জন্য অভিনন্দন জানিয়েছি। এরপর কীভাবে ওদের প্রস্তুতি চলছে এ নিয়ে কথা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ওরা তিনটা ম্যাচ হেরে গেছে। কিন্তু ওদের দলটাও খুব ভালো।  

বাংলানিউজ: শুধু শান্ত না, অন্য অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেও কথা বলেছেন। ডাটা নিয়ে তাদের আগ্রহ কেমন?

মহসিন: ডাটা ও অ্যানালাইসিসের গ্রহণযোগ্যতা এখন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্রিকেটারই এখন ভরসা করছে। আপনার সঙ্গে কথা বলার ঠিক আগেই আমি নাসুমের সঙ্গে কাজ করছিলাম। ওর অনুভূতিটা জানতে ও আমরা যা করছি তা বুঝাতে চাইছিলাম; দেখতে চেয়েছি ফিডব্যাকটা কী আসে ডাটা, ভিশন অ্যানালাইসিসের। এরপর যেন এটা তারা গ্রহণ করে ও খেলোয়াড়দের উন্নতিতে সাহায্য করে।  

বাংলানিউজ: তাদেরকে কি এখনও আপনার ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হয় নাকি নিজে থেকেই জানতে চায়?

মহসিন: এখনকার দিনের ক্রিকেটে ডাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ছেলেরা নিজেই এটা গ্রহণ করে। তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হয় না। অ্যানালিস্ট হিসেবে আমার ভূমিকা হচ্ছে খেলোয়াড়দের সম্পৃক্ত করা। তাদের সঙ্গে কথা বলে গেম প্ল্যানটা আগে বুঝতে হয়।  

কারণ আমি তাদের গেম প্ল্যান দেই না। আমি ওদের এনগেজ করি। ব্যাটার ও বোলারদের দুর্বলতার কথাও বলি। জানতে চাই ওদের পরিকল্পনা কী। ওদের নিজের স্কিলগুলো জানার চেষ্টা করি। তারপর ওদের এনগেজ করি।

বাংলানিউজ: আপনি তো শুরুর জীবনে কোচ ছিলেন, পরে ডাটা অ্যানালাইসিসে কীভাবে এলেন?

মহসিন: আমি অনেক লম্বা সময়ই কোচ ছিলাম। পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ছিলাম। আমি ডাটা অ্যানালাইসিস শুরু করি রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে প্রথম আইপিএলের সময়। ওখানে নতুন করে জানতে পারবো এমন অনেকে ছিল। শেন ওয়ার্ন ছিলেন...।

বাংলানিউজ: এখানে একটু থামিয়ে দিয়ে গল্পটা শুনতে চাই, শেন ওয়ার্নের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে হলো?

মহসিন: আইপিএল যখন শুরু হয়, তখন আমি অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে কাজ করতাম। আমরা সিডনিতে টেস্ট ম্যাচ খেলছিলাম, তখন শেন ওয়ার্নও ছিল। ওখানেই তার সঙ্গে পরিচয়। হুট করে আইপিএল শুরু হলো। তখন ওয়ার্ন আমাকে নিয়ে আসে রাজস্থান রয়্যালসে। তার মনে হয়েছিল আমি হয়তো দলে নতুন কিছু দিতে পারবো। ভারতেও তখন ডাটা বা অ্যানালাইসিসের তেমন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।  

যখন ওয়ার্ন আমাকে রাজস্থানে নিয়ে যায়, আমি শুধু খেলোয়াড়দের চিন্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করতাম, এটাই ছিল ভূমিকা। যেহেতু আমি কোচ ছিলাম, এটা আমার অ্যানালাইসিসে একটা আলাদা স্বাদ নিয়ে আসে। কারণ আমি কোচদের পয়েন্টটা বুঝতে পারতাম যখন অ্যানালাইসিস করতাম। এ কারণেই ওয়ার্ন আমাকে নিয়ে যায়।

বাংলানিউজ: শেন ওয়ার্নের সঙ্গে কোনো স্মৃতির কথা কি মনে পড়ে?

মহসিন: শেন ওয়ার্ন খেলা সবচেয়ে ভালো পড়তে পারতো। আমার পাঞ্জাবের বিপক্ষে জয়পুরে খেলা একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে। ওয়ার্ন ১০ ওভারের সময় আমার কাছে আসে, সে বলে তুমি কী ভাবছো? কারণ খেলাটা আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।  

আমি তাকে বলেছিলাম আমাদের ১১ থেকে ১৫তম ওভারের মধ্যে উইকেট নিতে হবে। যুবরাজ সিং আমাদের ওপর খুব চড়াও ছিল। ওয়ার্ন এসে এরপর ১২তম ওভার করে, যুবরাজকে আউট করে। আমরা ম্যাচ জিতে যাই।  

বাংলানিউজ: তার মৃত্যুর খবরটা কেমন শকিং ছিল?

মহসিন: পুরো দুনিয়াই হতবাক হয়ে গিয়েছিল, আমিও। অবসরের পরও সে খেলাটাকে ছেড়ে যায়নি। কোচিং করিয়েছে, ধারাভাষ্য দিয়েছে। অনেক মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। যদি আপনার সঙ্গে তার জীবনে একবার দেখা হয়, সে আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবে। এটা আসলে কিংবদন্তির গুণ।  

শুধু খেলার চেয়েও ওয়ার্ন অনেক বড় কিছু ছিল। তার ভাবনা, সাহস ও যেভাবে সে খেলাটাকে রিড করতে পারতো; আমি এমন কাউকে কখনো দেখবো বলে মনে হয় না।  

বাংলানিউজ: আপনি এই পেশায় এক যুগের বেশি কাটিয়ে দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা কেমন?

মহসিন: দুর্দান্ত। প্রথম কয়েক বছর কোচিং থেকে অ্যানালাইসিসে আসা ছিল আলাদা। কারণ ক্যারিয়ারের মধ্যে ক্যারিয়ার বদলেছি। আগে কোচ ছিলাম, পরে অ্যানালিস্ট হলাম। এরপর সাপোর্ট স্টাফ, হেড কোচ, বোলিং কোচের কাছে আরও কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ২০০৮ সালে প্রথম এটা শুরু করেছিলাম; ১৪-১৫ বছর হয়ে গেছে, আমি পেশাটাকে এখন ভালোবাসি, উপভোগও করি।

বাংলানিউজ: এশিয়া কাপে আপনার ভুলে আফগানিস্তান সুপার ফোরে যেতে পারেনি; এমন বলা হয়। ওই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আছে?

মহসিন: আমাকেও ঘটনাটা বাকি সবার মতোই কষ্ট দিয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে আমি ম্যাচ রেফারির কাছে গিয়েছিলাম ম্যাচ শেষ হওয়ার পরই; বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ভুলটা কী হলো। কারণ সবকিছুই একটা শিক্ষা। যদি আপনি না শেখেন, তাহলে এগিয়ে যেতে পারবেন না।  

আমি বিরতির সময়ও ম্যাচ রেফারিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও; আমাদেরকে একটা সংখ্যার কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু যদি ওই সিনারিওটা না হয়? আপনি যদি ডার্ক ওয়ার্থ লুইসের কথা চিন্তা করেন; নতুন একটা শিট চলে আসবে। আপনাকে নতুন সংখ্যা দেবে। যদি উইকেট যায়, নতুন নম্বর আসবে।  

যদি এক্ষেত্রে প্রতিবার আপডেট আসে, তাহলে রান রেটের কেন নয়। ডেভিড বুন তখনও বলেছিল, এমন ধরনের ঘটনা ১০০-১৫০ বছরে একবার ঘটে। তো জিনিসটা কমন না। এটা আসলে টেকনিক্যাল কমিটির জন্যও একটা নতুন শিক্ষা।  

যদি আমি না জানি, তাহলে দলও জানে না, শ্রীলঙ্কাও জানতো না; এটা শুধু একজন জানতো না, ব্যাপারটা এমন না। কেউই জানতো না মাঠে। যদি ধারাভাষ্যকাররা জানতেন, তাহলে কেন তারা সেটা স্কোরবোর্ডে যুক্ত করেনি।  

যদি তারা জানে এক পর্যায়ে এমন সিনারিও হতে পারে। তাদের দুই দলকেই জানানো দরকার ছিল, এটা স্কোরবোর্ডে যুক্ত করতে পারতো। তাহলে সবাই জানতো। এটা আসলে যোগাযোগের ব্যাপার। ক্রিকেট এখন যোগাযোগের ব্যাপার। যদি কোথাও গিয়ে যোগাযোগের ঘাটতি হয়, তাহলে কাউকে দোষ দেওয়া খুব সহজ।  

আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি ডার্কওয়ার্থ লুইস না থাকতো, আপনি জানতেন না বৃষ্টির হিসাব। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাপারটা দেখেন, ডার্কওয়ার্থ লুইসে যে আটকে গেছে; কারণ শিটে ঠিক নম্বরটা প্রিন্ট করা হয়নি। ওখান থেকে যেটা শেখা হয়েছে, প্রতিবার ডার্কওয়ার্থ লুইস বদলে গেলে সেটা জানাতে হয়।  

বাংলানিউজ: এরপর যে-ই সমালোচনা হলো আপনাকে নিয়ে, সেটা তো নিশ্চয়ই কষ্ট দিয়েছে?

মহসিন: অবশ্যই কষ্ট দিয়েছে। এটা অনেকটা খেলোয়াড়দের মতো ব্যাপার। আপনি যদি ক্রিকেটারদের দেখেন যখন তারা ঠিক করে না- তখন ভক্ত, মিডিয়া তারা খেলোয়াড়দের অ্যাবিউজ করা শুরু করে। যেটা ঠিক নয়। কোনো খেলোয়াড় বা অফিশিয়াল তারা এমন কিছু করে না যেটা খেলার ক্ষতি হয়। খেলা নির্ভুল। ক্রিকেট সবসময় এগিয়ে যাবে। ১৫০ বছর আগে খেলাটা শুরু হয়েছিল, এখনও চলছে। মানুষ আসবে, চলেও যাবে। ভক্ত ও সমর্থকদের বুঝতে হবে খেলাটা নির্ভুল। ক্রিকেট সবার আগে, কোনো ব্যক্তি আসবে পরে।

বাংলানিউজ: এরপর তো বিশ্বকাপে ভালোও করলেন?

মহসিন: ওই যে, শিখেছি। এমন কিছু সময় আসবে যখন ভালো যাবে না আপনার। এরপর আবার এগিয়ে যেতে হবে। কোথাও আটকে থাকার সুযোগ নেই আমাদের। আমরা কোথাও আটকে থাকিনি। এজন্যই আফগানিস্তান বিশ্বকাপে পঞ্চম হতে পেরেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।