ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

আনন্দ-বেদনার স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালে দেখা মিলল ‘জীবনেরও’

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৭ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৪
আনন্দ-বেদনার স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালে দেখা মিলল ‘জীবনেরও’

এখনও কেউই পেরোয়নি স্কুলের গণ্ডি। চেহারায় তাদের সারল্যের ছাপ, বয়স আঠারো না পেরোনোর অসীম আনন্দ।

প্রায় সবার মুখেই হাসির ঝিলিক। বরিশালের নদী পেরিয়ে এখন তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের কেন্দ্রে, তাদের কাছে হয়তো যেটি ‘সমুদ্র’ পাড়ি দেওয়ার মতো। রাজধানীরই বাসাবো থেকে যে স্কুল এসেছে ফাইনালে, পরে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন; তাদের জন্যও ঢাকার চাকচিক্যে থেকেও এই দুনিয়াটা একটু হলেও আলাদা।  

ফাইনালের পর ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে গেল যখন, তখনও তাই বাসাবোর কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুলের ছেলেরা শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একোণ, ওকোণে গিয়ে বন্দি করে রাখছে ‘মুহূর্ত’। কখনো একা, কখনো আবার সবাই একসঙ্গে। কে জানে এমন দিন আর আসে কি না কখনো। আজকের জন্য মিরপুরের মাঠটির মালিকানা তো তাদের!

একদিকে যখন এমন উল্লাস, আরেকদিকে বড় বেদনার ছবি; মলিন মুখে বাড়ি যাওয়ার তাড়া। চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া বাসাবো স্কুলের ছবি তুলতে কিংবা ভিডিও করতে যখন ক্যামেরার ভিড়; তখন পিরোজপুরের সরকারি কে জি ইউনিয়ন হাই স্কুলের জন্য ভরসা মুঠোফোন। ওই স্কুলের ক্রিকেটারদের বোঝার বয়স হয়েছিল কি না কে জানে, ‘জীবন তো আসলে এমনই হয়, পরাজিতরা থমকে থাকে একপ্রান্তে...। ’

কে জি স্কুলের বেদনা শুনতে তাদের খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, সবাই ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেছে বহু আগে। পরে যখন তাদের অধিনায়ক হৃদয়কে পাওয়া গেল, তার প্রথম কথাটুকুই এল হৃদয়ের ভেতর থেকে, ‘জানেন, ম্যাচটা একদম হাতের মুঠোয় ছিল আমাদের। এরপর কী যে হলো...’

কী হলো কে জানে। হয়তো চাপ নিতে না পারার কারণে। হয়তো অতিরিক্ত কোনো রোমাঞ্চ। নয়তো ৪৩ রানে ছয় উইকেট নেওয়ার পর প্রতিপক্ষ কীভাবে ২৮৬ রান করে ফেলল, ওই ম্যাচে এরপর তাদের হার ১৮৭ রানে! এমন সমীকরণের উত্তর মিলছে না পিরোজপুরের স্কুলের অধিনায়কের কাছে।  

হৃদয় না পারলেও হিসাবটা ঠিকঠাকই ছিল শাহরিয়ার সামির। ৬ উইকেট চলে যাওয়ার পর কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুলকে টেনে তোলার নায়ক এই খুদে ক্রিকেটার। ১১৫ বলের ইনিংসে ৯ চার ও ৬ ছক্কায় ১৪৮ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে।  

অথচ সামির ব্যাটিং নিয়ে যখন জানতে চাওয়া হলো কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুলের কোচ মোস্তাফিজুর রহমান শাহিরয়ারের কাছে, তার বিস্ময় যেন একটুও কাটেনি তখনও, ‘শতভাগ সারপ্রাইজিং ছিল তার ব্যাটিং। সে তো আমার দলের বোলার। বোলিংয়ের কারিশমা অনেক ভালো। আমাদের মোস্তাফিজের কাটিং...সব ধরনের বল সে করতে পারে। ’

ব্যাটিং না পারা সামি তাহলে কীভাবে পেল সেঞ্চুরির স্বাদ? মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন একটি পেছনের গল্প, ‘ওকে শুধু বললাম, মিরপুরের মাঠ। জীবনে আর কখনো সুযোগ আসবে কি না, আমি জানি না। তোমার জন্য হতে পারে এটাই শেষ মঞ্চ অথবা জাতীয় দলের চেইনে ঢুকতে পারার সুযোগ। হয়তো সে কথাটা মাথায় নিয়েছে। শুরুতে পিচে থেকেছে। পরে দিন যত গেছে মনে হয়েছে অনেক ভালো ব্যাটার। আমার দৃষ্টিতে সে এত বড় ব্যাটার না আসলে। ’

অথচ এমন বিস্ময়কর ব্যাটিং দেখিয়ে, যখন মঞ্চটা কেড়ে নেওয়ার কথা সামির- তখন আরও একবার বাধা হলো নিয়তি। ‘জীবন তো এমনই...’ হয়তো কোনো একদিন কোথাও মঞ্চে উঠতে না পারার দুঃখে এমনটা বলা হবে তার। প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যাট করার পর দলের জন্য বোলিং করতে প্রস্তুত ছিল সামি।  

কিন্তু  জীবন তাকে আলোতে আসতে দেয়নি আরও একবার। প্রথম ওভারের পাঁচ বল করার পর মাটিতে পড়ে যায় সামি। চোখই মেলাই কঠিন ছিল তার জন্য, কথা তখনও অনেক দূর। হিট স্ট্রোক করায় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো বাসাবোর এক হাসপাতালে।  

তার সতীর্থরা যখন খোঁজ পেল, সামি ভালো আছে; ততক্ষণে তাদের হাতে উঠে গেছে বহু পথ পাড়ি দিয়ে আসা ট্রফি। রমজান মাসে যখন বাসাবো মাঠের দরজায় বন্ধ থাকতো, তারা তখন দেয়াল টপকে মাঠে যেত শিরোপার স্বপ্নকে লালন করে।

তাদের আনন্দ আড্ডায় একটু দুশ্চিন্তা থাকলো সামিকে ঘিরে, তার সুস্থতার খবর হয়তো এনে দিলো স্বস্তিও। স্বপ্নের দুনিয়া আরেকটু রঙিন হলো মিরপুরে এসে। এই মাঠে কত কত তারকাকে খেলতে দেখেছে তারা। দুয়েকজন স্বপ্নের নায়কদের দেখাও পেয়েছে আজ।  

সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া নূর আহমেদ সিয়াম, চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক সিয়াম অথবা যার কাছেই জানতে চাওয়া হলো- তারা কেবল বলল রোমাঞ্চের কথা। আগের রাতটা তাদের কেটেছিল স্বপ্নের মাঠের খেলার ভাবনাতেই।  

কিন্তু আজ? কোথাও আনন্দ, কোথাও বেদনা, কোথাও সব পেয়েও আলোতে না আসার গল্প, কোথাও স্বপ্ন ছুটে গেলো ‘হাতের মুঠো থেকে...। ’ কেউ হয়তো বুঝবে অথবা সবাই-ই কখনো না কখনো, ‘জীবন এমনই...’। স্কুল ক্রিকেটের ফাইনালের মঞ্চ তাদের আদতে কী শেখাল? সম্ভবত জীবন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৭ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৪
এমএইচবি/আরইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।