ভারত ও শ্রীলঙ্কায় আয়োজিত নারী ওডিআই বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের তরুণ পেসার মারুফা আক্তারের ভাবনায় ছিল শুধুই একটি বিষয়, কীভাবে বিশ্বমঞ্চে নিজের অভিষেকটা স্মরণীয় করে রাখা যায়।
পাকিস্তানের বিপক্ষে দলকে দুর্দান্ত এক জয় এনে দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি যখন ঘুমাই, তখনও ভাবি প্রথম ম্যাচে আমাকে ভালো কিছু করতে হবে।
কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের মন্থর উইকেটের কথা ভেবে বাংলাদেশ দল সাজানো হয়েছিল মূলত স্পিনারদের নিয়ে। একাদশে একমাত্র পেসার হিসেবে সুযোগ পেয়ে ২০ বছর বয়সী মারুফা প্রমাণ করে দিয়েছেন, একাই একশ হওয়া কাকে বলে। গতি, শক্তি আর দুর্দান্ত সুইংয়ে পাকিস্তানের ব্যাটারদের পরাস্ত করতে তার যেন কোনো কিছুরই কমতি ছিল না।
অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি মিচেল স্টার্কের ভক্ত মারুফা নিজের রোল মডেলকে দারুণভাবে অনুসরণ করছেন। ইনিংসের প্রথম ওভারেই তার আগুনে বোলিংয়ে পুড়েছে পাকিস্তান। পরপর দুই বলে ওমাইমা সোহেল এবং ইনফর্ম সিদরা আমিনকে ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ গুঁড়িয়ে দেন তিনি। তার এই বিধ্বংসী বোলিং নজর কেড়েছে শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি লাসিথ মালিঙ্গারও। মারুফার জোড়া উইকেটের ভিডিও পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘খাঁটি স্কিল, দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ। এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টের সেরা ডেলিভারি। ’
এই পারফরম্যান্স মনে করিয়ে দেয় ২০২৩ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তার সেই বিধ্বংসী স্পেলের কথা। সেদিনও পরপর দুই বলে দুই ব্যাটারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যদিও ম্যাচটি বাংলাদেশ জিততে পারেনি। তবে তার প্রতিভার সবচেয়ে বড় নিদর্শন ছিল ২০২৩ সালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রথম ওডিআই জয়। সেদিন মাত্র ২৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন মারুফা, যার মধ্যে ছিলেন স্মৃতি মান্ধানার মতো তারকা ব্যাটারও।
স্মৃতি মান্ধানা মারুফার প্রশংসায় বলেছিলেন, ‘ওর বয়স কোনো ব্যাপারই না। মাঠে ও যে পরিমাণ চেষ্টা করে এবং ক্রিকেটার হিসেবে ওর মধ্যে যে আগুনটা আছে, তা এককথায় অসাধারণ। ওর বল যতটা ভাবা হয়, তার চেয়ে বেশি স্কিড করে। ঢাকার মন্থর উইকেট ওকে খুব একটা সাহায্য করে না। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় ও কী করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব। ’
একসময় মারুফা ছিলেন হালকা-পাতলা গড়নের এক কিশোরী, যিনি মাঠে প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতেন। সেই আবেগ এখনও আছে, তবে সঙ্গে যোগ হয়েছে শারীরিক সক্ষমতা এবং কৌশলগত উন্নতি। বাংলাদেশ দলের সাবেক স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ ইয়ান ডুরান্টের অধীনে নিজেকে বদলে ফেলেছেন তিনি।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এক ভিডিওতে মারুফা বলেন, ‘আগে আমি ২৫-৩০ কেজি বেঞ্চ প্রেস করতাম। এখন ৪২-৪৪ কেজি করি। ৩০-৩৫ কেজি দিয়ে স্কোয়াট করতাম, এখন সেটা ৬০ কেজিতে পৌঁছেছে। ’
উইকেটের পেছন থেকে মারুফার এই বদলে যাওয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি। তিনি বলেন, ‘আগে ও নিজের বোলিং বা পরিকল্পনা নিয়ে খুব বেশি ভাবত না। আমিই ওকে সাহায্য করতাম। কিন্তু এখন ও অনেক পরিণত। ডেথ ওভারে কীভাবে বল করতে হবে, বাঁ-হাতি বা আক্রমণাত্মক ব্যাটারদের বিরুদ্ধে কী কৌশল নিতে হবে, তা নিয়ে ও এখন নিজেই ভাবে। ’
জ্যোতি আরও যোগ করেন, ‘আমাদের দেশে ওর মতো খেলোয়াড় দীর্ঘদিন আসেনি। ওর অ্যাকশনটা ভিন্ন এবং যে গতিতে ও সুইং করাতে পারে, তা বিরল। ভালো দিক হলো, কোচরা ওর মূল কৌশল পরিবর্তন না করে সেটিকে আরও ধারালো করছেন। ’
একটা সময় ছিল যখন মারুফার আজকের এই জীবন ছিল এক সুদূর স্বপ্ন। মহামারীর সময় ক্রিকেটার ও কোচ আরিফা জাহান বিথির কিছু ভিডিওর মাধ্যমে মারুফা প্রথম জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় আসেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মারুফা তার বাবার সঙ্গে ধানের জমিতে লাঙল দিচ্ছেন। মহামারী তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর আগেই প্রায় শেষ করে দিচ্ছিল।
কৃষিকাজ করে বেড়ে ওঠা মারুফার সহজাত অ্যাথলেটিসিজম তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। আরিফা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মাঠে কঠোর পরিশ্রম করার অভিজ্ঞতা ওকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওভারে ওরকম পেস বোলিং দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। ’
একসময় যে কৃষক বাবা চাইতেন মেয়ে সাধারণ কোনো চাকরি করুক, মেয়ের সাফল্যে আজ তার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে। মারুফা বলেন, ‘যখন আমি ভালো খেলতে শুরু করলাম, আমার পরিবার আমাকে ভীষণ সমর্থন করতে শুরু করে। ’
মাত্র ১৫ বছর বয়সে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ট্রায়ালে সুযোগ পাওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ দলের পেস আক্রমণের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠা—মারুফার যাত্রাটা সিনেমার গল্পের মতোই। এক সময়ের লাজুক কিশোরী আজ আত্মবিশ্বাসী এক যোদ্ধা।
উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ (ডব্লিউপিএল) বা উইমেন্স বিগ ব্যাশ লিগের (ডব্লিউবিবিএল) মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকলেও আপাতত তিনি বিশ্বকাপেই মনোযোগ দিতে চান।
অধিনায়ক জ্যোতি মনে করেন, ‘এই বিশ্বকাপে মারুফা যেভাবে শুরু করেছে, তাতে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর নজর কাড়া উচিত। তবে আপাতত ওর বিশ্বকাপেই মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়ার দিকে নজর রাখা দরকার। ’
তবে এতকিছুর মাঝেও মারুফার দর্শন খুব সহজ। তিনি বলেন, ‘আমার লড়াইটা সবসময় নিজের সঙ্গে, অন্য কারও সঙ্গে নয়। ’ যারা এখনো তার মুখোমুখি হননি, তাদের জন্য হয়তো এটি একটি শান্ত সতর্কবার্তা। আর ক্রিকেট বিশ্ব তার পরবর্তী ঝলক দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সেই অপেক্ষার পালা হয়তো আজই শেষ হবে। কারণ আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ৩টায় ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এই ম্যাচেই আরও একবার বোলিং ঝলক দেখাতে চাইবেন মারুফা।
এমএইচএম