ওয়েলিংটন (নিউজিল্যান্ড): নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে স্যারতো একজনই। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি।
হ্যাঁ, দুটো দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে একটু রেশারেশি যে নেই- তা বলা যাচ্ছে না। অন্তত খেলাধুলার ক্ষেত্রে। মার্টিন ক্রো‘র আগ পর্যন্ত যে দু’জন ক্রিকেটের আইসিসির হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছিলেন। তারা দু‘জনেই সাউথ আইল্যান্ডের। তাই মার্টিন ক্রো যখন আইসিসি’র ফল অব ফেমের পুরস্কার নিলেন ইডেনপার্কে, তখন নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি প্রথম নর্দান আইল্যান্ডার হিসেবে পুরস্কারটা পেয়ে সত্যিই গর্বিত! গর্বিত আমার বন্ধু রিচার্ড হ্যাডলির পাশে নাম লেখাতে পেরে। ’ সঙ্গে সঙ্গে ইডেন পার্কের চল্লিশ হাজারের বেশি দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন! এটা শুধু মার্টিন ক্রো-কে সম্মানিত করা হলো না। মনে হলো গোটা নর্দান আইল্যান্ডবাসী সম্মানবোধ করলেন।
এরপর দিন মার্ক গ্রেটব্যাচ তো বলেই ফেললেন; ‘আমার বন্ধু মার্টিনের এই সম্মানটা অনেক দিন ধরেই প্রাপ্য ছিল। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত পেলো। আমরা তোমার জন্য গর্বিত বন্ধু। ’ প্রায় একই সময়ে অকল্যান্ডে বেড়ে ওঠা মার্টিন ক্রো আর মার্ক গ্রেট ব্যাচের। ক্রিকেটও খেলেছেন একসঙ্গে। ’৯২ এর বিশ্বকাপে এই গ্রেটব্যাচকে দিয়ে ইনিংস ওপেন করিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন ক্রো। সেই ক্রো’র সম্মানে দারুণ উচ্ছ্বসিত গ্রেটব্যাচ।
কিন্তু উচ্ছ্বাস আরও কয়েকজনকে ঘিরে। উইলিময়াসনের সেই ছক্কার কথা যেন ভুলতে পারছেন কেউ। শারজায় আশির দশকে ভারতের বিপক্ষে জাভেদ মিয়াঁদাদের সেই ছক্কার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে উইলিয়ামসনের ছক্কাকে! এবং সেটা হতেই পারে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানে যদি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বির লড়াই, তাহলে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার এই লড়াইকে কী বলবেন! চির প্রতিদ্বন্দ্বীতো বটেই । বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। এই লড়াই দেখতে দু’টো দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মাঠে হাজির হয়েছিলেন! ম্যাচটার উত্তেজনার পারদ কোন স্তরে ছিল, সেটা বুঝতে বাকি কিছু লাগে না।
কিন্তু ভাবা কঠিন, ওরকম একটা ম্যাচে সবাই যখন টেনশনে- সেই সময় মাথাটাকে বরফের মতো ঠাণ্ডা রেখে কীভাবে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা মারলেন উইলিয়ামসন! আর প্যাট কমিন্সের বলের গতি ১৪০ কিলোমিটারের উপরেই ছিল। উইলিয়ামসনের সেই ছক্কা দিয়েই ম্যাচ জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। জয়ের জন্য তাদের দরকার ছিল ঠিক ছয় রান। যদিও বল বাকি ছিল অনেক। কিন্তু উইকেট? মোটে এক উইকেট হাতে ছিল। তাও উইলিয়ামসনের সঙ্গে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। আর সেই বোল্টের সামনে ছিলেন মিচেল র্স্টাক। যিনি বলে আগুন ঝরাচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে উইলিয়ামসন ছক্কা দিয়েই ম্যাচ শেষ করলেন! নিউজিল্যান্ড পেলো এক উইকেটের জয়।
সেই জয়ের রেশ এখনো নিউজিল্যান্ডজুড়ে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর আনন্দটাই আলাদা। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবচেয়ে নাটকীয়-প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ এটি। যা শেষ হয়েছিল রুদ্ধশ্বাস এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে। এরপর কেন উইলিয়ামসন মোটামুটি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে লোকগাথায় জায়গা করে নিলেন। ম্যাচ শেষে উইলিয়ামসন বলেও ছিলেন, তিনি টোটাল স্কোরের কথা মাথায় রাখেননি। চেয়েছিলেন একটা বাউন্ডারি মারতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলটা পেয়ে গেলেন ছক্কা মারার জন্য। মারলেনও। কারণ ছিল একটাই। ‘মিচেল স্টার্ক যেভাবে পুরো ইনিংসজুড়ে বল সুইং করাচ্ছিলেন, তাতে তার সামনে বোল্টকে ফেলে দেয়া মানে বাঘের মুখে ছাগল রাখার মতো ব্যাপার হয়ে যেতো। সেটা আমি চাইনি। ’
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এরকম রূপান্তরের অন্যতম নায়ক বলা হচ্ছে ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে। দলটাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। শুধু তাই নয়। ব্যাটটাও করছেন দুর্দান্ত। সাহস আর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে অনেকেই এখন তাকে ডাকতে শুরু করেছেন, ‘স্যার ব্রেন্ডন...!’ আর কেন নয়? ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসেই যেন ম্যাককালাম অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেরছেন! তাঁ ক্যাপ্টেন্সি দেখে মুগ্ধ নিউজিল্যান্ডের সাবেকরা। মার্টিন ক্রো থেকে রিচার্ড হ্যাডলি, গ্রেটব্যাচ থেকে স্টিফেন ফ্লেমিং কে নেই সেই দলে! আর থাকবেন না কেন? ম্যাককালামের ব্যাটিং যেরকম আগ্রাসী, প্রো-অ্যাকটিভ ঠিক তেমনি তার নেতৃত্বও। বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড প্লেসমেন্ট এতো নিখুঁত ছিল যা দেখে তরুণদের শেখার অনেক কিছু আছে। সত্যি, ক্যাপ্টেন্সির মাস্টার ক্লাস তিনি। আগামীতে তিনি যদি স্যার হয়ে যান অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কিন্তু অবাক হতেই হচ্ছে মধ্য ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া এক ভদ্রলোক যেভাবে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছেন তা দেখে। ওয়েলিংটন দেখলো কুমার সাঙ্গাকারার আরেকটা দুর্দান্ত ইনিংস। এরকম ইনিংস অন্য কেউ খেললে তাকে নিয়ে হয়তো মাতামতাতি হতো অনেক। কিন্তু তিনি সাঙ্গাকারা। কথা যখন বলেন, তা শুনতে হয় মুগ্ধ হয়ে। ব্যাট যখন করেন দেখতে হয় মুগ্ধতার চশমা পরে। বিশ্বকাপ মঞ্চে চার ম্যাচে দু‘টো সেঞ্চুরি। তাও পরপর দুই ম্যাচে। বাংলাদেশের বিপক্ষে মেলবোর্নে সেঞ্চুরির পর ওয়েলিংটনে করলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেটা আবার মাত্র ৭০ বলে! এটা তার ক্যারিয়ারের দ্রুততম সেঞ্চুরি।
কতো বড় মাপের ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা তা বোঝানোর জন্য এখন আর বাড়তি শব্দ খরচ করার দরকার পড়ে না। বিশ্বকাপের পরই তিনি অবসরে যাচ্ছেন। এটাই তার শেষ ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। একে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছেন তিনি। নিজের কাজটাতো করেই যাচ্ছেন। শেষ টুর্নামেন্টেও তিনি দ্রুততম সেঞ্চুরির করলেন! কিংবদন্তি হতে বাকি রইলো কী তার? মিডিয়ার মাতামাতি! না, ওটা না হলেও কুমার সাঙ্গাকারা ক্রিকেট কিংবদন্তি। লর্ডসে ২০১১ সালে যে বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন, তা শোনার পর তাকে ‘প্রফেসর’ সাঙ্গাকারা-ই ডাকা উচিৎ।
ম্যাককালামকে যদি তার দেশের মানুষ ‘স্যার’ ডাকতে শুরু করেন, তাহলে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার মানুষের উচিৎ কুমার সাঙ্গাকারাকে ‘প্রফেসর’ ডাকা। ক্রিকেটে তার গ্রেটনেস অস্বীকার করার উপায় আর নেই। টেকনিক্যালি নিখুঁত, টেস্ট, ওয়ানডে যেখানেই বলা হোক, দলের প্রয়োজনে রান করে দিচ্ছেন। আর দ্রুত রান তোলার ক্ষেত্রেও ব্রেন্ডন ম্যাককালামদের মতো টি-টোয়েন্টি প্রজন্মকেও ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন ‘প্রফেসর’ সাঙ্গাকার।
স্যার ডনের দেশে সেঞ্চুরি করে এসেই স্যার রিচার্ড হ্যাডলির দেশে পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি ক’জন করে দেখিয়েছেন!
** জীবনের গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়ে মার্টিন ক্রো!
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৫