উপমহাদেশীয় ক্রিকেট আবেগের স্রোত বইছে ইয়ারা নদীর দু’কুলে। তার এক পাড়ে যদি আছড়ে পড়ে নীল ঢেউ, অন্যপাড়ে অবশ্যই সবুজ।
সিডনিতে বাঙালিদের মধ্যে মেলবোর্নের ফ্লাইট ধরার যে তোড়জোড় চলছে, তাতে কে বলবেন আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে এসসিজেতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল! যে ম্যাচে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের দুই বড় শক্তি দক্ষিণ আফ্রিকা আর শ্রীলংকা।
শুধু তাই নয়, ম্যাচটা শুরুর আগেই আলোচনায় দুই ক্রিকেট গ্রেট। কুমার সাঙ্গাকারা আর এবিডি ভিলিয়ার্স। বিষণ্নতার চাদরে মুখ ঢেকে কে বেরিয়ে যাবেন বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে? নামটা যদি হয় কুমার সাঙ্গাকারা তাহলে অনেক বর্ণময় চরিত্রের সরণিতে থাকবে তার নামটাও। কিন্তু কুমার সাঙ্গাকারা কেন, কোনো শ্রীলংকানই চাইছে না ক্লাইভ লয়েড-স্টিভ ওয়াহদের তালিকায় তার নামটা কোনোভাবেই ঢুকে পড়–ক! না, কোনভাবেই কুমার সাঙ্গাকারা চাইছেন না সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড হয়ে থাকুক তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচের স্মৃতিজাদুঘর।
দূরে, আরো দূরে মেলবোর্ন হোক কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়ী ম্যাচের মঞ্চ, এটাই ভাবনা।
তাহলে যে এবিডি ডিভিলিয়ার্স এবং তার দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ট্র্যাজেডি কী অব্যাহত থাকবে? আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপে কোনো নক আউট ম্যাচ জিততে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা! ব্যর্থতার সেই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে কি দক্ষিণ আফ্রিকা সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে? ভাঙার জন্য শুধু ক্রিকেটকেই ‘পাখির চোখ’ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকানার। ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে রাজি নন তারা।
‘অতীতে পারিনি বলে ভবিষতে পারবো না তা ভাবছেন কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন ছিলো সংবাদ সম্মেলনে এবিডি ভিলিয়ার্সের। সকালে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের প্রেস কনফারেন্স হলে এলেন এবিডি। কিন্তু তিনি কিংবা তার দল কোনো প্র্যাকটিস করলেন না ম্যাচের আগের দিন। ‘রিল্যাক্স, শুধুই রিল্যাক্স ম্যাচের আগের দিন। ক্রিকেট আমাদের ভাবনায় থাকবে। তবে তা কোনোভাবে মানসিক চাপ তৈরির জন্য নয়,’ স্পষ্ট বলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক।
স্পষ্ট করার আরো একটা জিনিস অনির্বাযভাবে এসে পড়লো দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়কের প্রেস কনফারেন্সে। ‘চোক’! শব্দটা কেন যেন বার বার ঘুরপাক খায় সাউথ আফ্রিকা দলের সাথে। ’৯২ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বকাপে তারা নক আউট পর্বের কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি। তাই ছোট্ট ঐ শব্দটা তাদের সঙ্গী হয়ে আছে! ‘চোকার’ অপবাদটাকে মুছে ফেলার জন্য এই ম্যাচটা শুধু নয়, এবারের বিশ্বকাপটাকেই বেছে নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেকথাটা পরিষ্কার করে বললেন এবিডি।
এই ম্যাচটাকে অনেকে বলতে চাইছেন এবিডি ভিলিয়ার্স বনাম কুমার সাঙ্গাকারার অঘোষিত ব্যক্তিগত লড়াইও বটে। কিন্তু তাতে প্রবল আপত্তি এবিডির। ‘না, কোনো ব্যক্তির লড়াই এটা নয়। হতে পারে না। এটা দুটো ভাল ক্রিকেট প্লেয়িং দেশের লড়াই। সেখানে আমরা জিততে চাই। সেই জয়টা যদি আমাদের এগার নম্বর ব্যাটসম্যানের সৌজন্যে আসে তাতেও আমরা খুশি হবো। আমাদের কাছে প্রথম আর শেষ কথাটা অবশ্যই ‘জয়’। অন্য কিছু নয়। কারো সেঞ্চুরির চেয়েও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে কারো কাছ থেকে একটা ম্যাচ উইনিং ইনিংস,’ বললেন এবিডি ভিলিয়ার্স।
প্রায় একই সুর শ্রীলংকান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলা ম্যাথিউসের গলায়। জয়টাই বড় কথা তার কাছে। তবে কুমার সাঙ্গাকারা আর মাহেলা জয়বর্ধনের জন্য তিনি চান কাপটা জিততে। পরপর দুটো বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছে শ্রীলংকা। কিন্তু ’৯৬ এর পর আর কাপ জেতা হয়নি তাদের। এবার আর সেই হাহাকারটা যেন ছুঁয়ে না যায় সাঙ্গাকারা বা মাহেলাকে। সেটাই চাইছেন লংকান অধিনায়ক।
‘গ্রেট। ওরা দুজনেই লংকান ক্রিকেটের কিংবদন্তী। তাদের বিদায়টা কাপ হাতে নিয়ে হোক। সেটাই আমরা চাইছি,’ বললেন অ্যাঞ্জেলা ম্যাথিউস।
তবে কাপ হাতে নিতে হলে আগে সিডনিতে জিততে হবে। তারপর ইডেন পার্কের টিকিট নিয়ে জিততে হবে সেখানে। তারপরই তো মেলবোর্ন। লংকান অধিনায়ক স্বীকারও করলেন: বিশ্বকাপের এই তিনটা ম্যাচ তারাই জিতবে যারা ভুল করবে না। এখন প্রত্যেকটা ম্যাচ হচ্ছে ‘মৃত্যুকূপ’। একটু ভুল করেছেন তো আপনার বিদায় অনিবার্য!
সিডনিতে তাই ভুল করতে চায় না লংকানরা। ভুলের মাত্রা যাতে কম থাকে তাই লম্বা একটা সেশন প্র্যাকটিসও করে গেলো তারা। প্রধান নির্বাচক সনৎ জয়সুরিয়া নিজেও থাকলেন প্র্যাকটিস সেশনে। ইনজুরি আক্রান্ত রঙ্গনা হেরাথ খেলতে পারবেন কি না সেজন্য অপেক্ষা ম্যাচের দিন সকাল পর্যন্ত। তবে লংকান অধিনায়কের ভাষায়: ওর খেলার সম্ভাবনা ‘ফিফটি-ফিফটি’।
কিন্তু এসসিজির গ্যালারিটাকে কোনোভাবেই ফিফটি ফিফটি করতে চাইছে না লংকানারা। ভাববে কেন? লংকান অধিনায়ক তো বলেই গেলেন: কলম্বো কিংবা ক্যান্ডিতে ম্যাচ খেলার সঙ্গে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না তিনি সিডনি বা মেলবোর্নে!
‘আমার তো মনে হয় সিডনি বা মেলবোর্নে খেলা মানে অনেকটা হোমেই খেলা। অস্ট্রেলিয়ায় যতো প্রবাসী শ্রীলংকান আছে তারা যেভাবে ছুটে আসে ম্যাচ দেখতে, যেভাবে আমাদের সমর্থন করে যাচ্ছে তাতে কখনো মনে হয় না আমরা বাইরে খেলছি। আশা করছি, এ ম্যাচেও গ্যালারি ভরে থাকবে লংকান সমর্থকে। ’
তবে হোম হোক আর অ্যাওয়ে হোক দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর কাজটা কঠিন মানলেন লংকান অধিনায়ক। এ পর্যন্ত বিশ্বকাপে চারবার মুখোমুখি হয়েছে এ-দুটো দল। দুই বার জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। একবার শ্রীলংকা। আর একটা ম্যাচ টাই। পরিসংখ্যানের এই চাপ নিতে চায় না লংকানরাও। ইতিহাস পাল্টে দিয়ে এই ম্যাচটা ‘ঐতিহাসিক’ ম্যাচে পরিণত হবে বলে ধারণা অ্যাঞ্জেলার। তার জন্য এবিডিকে খুব তাড়াতাড়ি ফেরাতে হবে। তা আগে কিংবা পরে যখন-ই ব্যাট করুক দক্ষিণ আফ্রিকা।
এবিডিকে ফেরানো। ডেইল স্টেইনকে সামলানো। এর পাশাপাশি ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ মাহেলার একটা বিগ ইনিংস। এটাই হচ্ছে সিডনির এই ম্যাচটার গায়ে ‘ঐতিহাসিক’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার আপাতত খুব জরুরি চাহিদা, ধারণা লংকান অধিনায়কের। আর তাহলেই কুমার সাঙ্গাকারার মতো গ্রেট ক্রিকেটারকে সিডনিতেই বিদায় বলতে হবে না ওয়ানডে ক্রিকেটকে। নাকি ‘বিদায়’ শব্দটাকে আরো সপ্তাহ দুয়েকের জন্য তুলে রাখতে সাঙ্গাকারার ব্যাটটাই আরো চওড়া হয়ে উঠবে এসসিজিতে।
এসসিজি, ইডেন পার্ক নয়, সাঙ্গাকারা ব্যাট তুলে রাখার জন্য এমসিজিকেই বেশি পছন্দ করছেন। তাহলে এসসিজি কি সাউথ আফ্রিকার জন্য আবার একটা বিদায়ের মঞ্চ হয়ে দাঁড়াবে?
বাংলাদেশ সময় ১৫০৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫
** তবু ‘চোক’ শব্দটাকে এড়ানো যাচ্ছে না | সিডনি থেকে অঘোর মন্ডল
** জয়ের চেয়ে ভাল প্রস্তুতি আর কি হতে পারতো!| অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হ্যাডলিও || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** মাহমুদুল্লাহর ইনিংস টেনে আনলো মার্টিন ক্রো-কে। । অঘোর মন্ডল, হ্যামিল্টন থেকে
** ক্লাস অব জিরো এইট! || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অ্যাডিলেডে শরতের রংও যেন লাল-সবুজ | অঘোর মন্ডল, অ্যাডিলেড থেকে
** ওয়ানডে-তে বোলাররা এখন শ্রমিকের ভূমিকায়! অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অনেক নাটক জন্ম দিতে পারে ইডেন পার্ক ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইয়র্কার এখন বিরল ডেলিভারি!॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** বিশ্বকাপের রান উৎসবে বাংলাদেশও ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** নেলসনে টাইগারদের তিন ‘ল্যান্ড’ হার্ডল ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইংল্যান্ড পারলে বাংলাদেশ কেন নয়? । । অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে