ঢাকা: স্বপ্নের বিশ্বকাপ মিশন শেষে বাংলাদেশের টাইগাররা এখন দেশে। প্রত্যাশার চেয়েও ভালো পারফর্ম করে বিশ্বকাপ মিশনের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
সফল বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে দেশে ফেরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বিশ্বকাপে যে লক্ষ্য নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছিল তা পূরণ হলেও কিছুটা আক্ষেপ থেকে গেছে টাইগার শিবিরে। প্রাথমিক লক্ষ্যে সফল হলেও সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের। সেমিফাইনাল খেলতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অনেক অর্জন রয়েছে বলে মনে করেন টাইগার দলপতি মাশরাফি।
দেশে ফিরে মিডিয়াকর্মীদের সামনে ব্যাটিংয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিমের প্রশংসা ঝড়ে মাশরাফির কন্ঠে। এছাড়া রুবেল হোসেনের বোলিংকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ আখ্যা দেন। এসময় মাশরাফি বলেছিলেন, ‘২০০৮ সালের পর থেকে আমরা অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে খেলিনি। এটা অবশ্যই কঠিন ছিল আমাদের জন্য। ’ কিন্তু সে কঠিন কাজকে অতিক্রম করার সামর্থ্য টাইগার শিবিরে আছে, তা প্রমাণ করেছে মাশরাফি বাহিনী।
এবারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পর আগামী বিশ্বকাপে (২০১৯ বিশ্বকাপ) বাংলাদেশের লক্ষ্য কী হতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেছিলেন, আগামী বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত লড়াই করার মানসিকতা থাকা উচিত। বিশ্বকাপের লড়াকু মনোভাব সামনের সিরিজগুলোতে কাজে লাগাতে পারলে সত্যিই দেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে বহুদূর।
সামনেই বাংলাদেশের হোম সিরিজ। এপ্রিলে পাকিস্তান দল পূর্ণঙ্গ সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসবে। এরপর দক্ষিন আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে সিরিজ রয়েছে। মাশরাফি আশা করেন বিশ্বকাপের আত্মবিশ্বাস সামনের সিরিজগুলোতে কাজে লাগাবে দল। কোটি কোটি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরাও তাই মনে করেন।
পরের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। চলতি বিশ্বকাপে এই ইংলিশদের হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে টাইগাররা। হয়তো স্বাগতিক দেশ হিসেবে ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংলিশরা কন্ডিশন সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবে।
এবারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড তাদের নিজেদের মাটিতে খেলে কন্ডিশন আর বাড়তি কিছু সুবিধা নিয়ে ফাইনালে উঠেছে। কিন্তু এ দলটিই বাংলাদেশ সফরে এসে টাইগারদের কাছে নাকানি-চুবানি খেয়েছিল। আর এগারোতম বিশ্বকাপে স্বাগতিক হিসেবে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে খুব সহজে জিততে পারেনি কিউইরা। উল্টো টাইগাররাই ম্যাচে কিউই পাখিদের চোখ রাঙিয়েছে।
তাই বলা যায়, পরের বিশ্বকাপে ইংলিশ কন্ডিশন আর স্বাগতিক দেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই টাইগারদের। বরং টাইগারদের নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার অন্য দলগুলোর। কারণ, পরের বিশ্বকাপে আইসিসির সহযোগী দেশগুলো না থাকলে, তাদের চিবিয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না বাকি দলগুলোর।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলটি নিজেদের আরও গুছিয়ে নিতে পারবে। ব্যস্ত ক্যালেন্ডার আর বড় বড় দলগুলোর বিপক্ষে আগামী চার বছরে খেলে বর্তমান তরুণ ক্রিকেটাররা নিজেদের অভিজ্ঞতা আরও বাড়িয়ে নিতে পারবে।
এবারের বিশ্বকাপে কতগুলো রত্নের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি আর মাহামুদুল্লাহর পাশে থেকে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা অন্য ধাতুতে গড়া।
তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেনরাই ২০১৯ বিশ্বকাপে বিশ্ব কাঁপাবে। সে সময় বাংলাদেশের পেস অ্যাটাকের মূল অস্ত্র হিসেবে তারা ভূমিকা রাখবে। সঙ্গে অলরাউন্ড পারফর্ম করে ব্যাটিং অর্ডারে সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকার তো রয়েছেই। মমিনুল হক সৌরভ, নাসির হোসেন আরও পরিণত ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করবেন। স্পিন জাদুতে প্রতিপক্ষের শিবিরে ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দেবেন বর্তমান সময়ের তরুণ স্পিনার তাইজুল ইসলাম, আরাফাত সানিরা।
আর ব্যাটিংয়ে মিডল অর্ডারে থাকবেন নির্ভরযোগ্য মাহামুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসানরা। ওপেনিংয়ে থাকবেন তামিম ইকবাল। যার ব্যাটিং টেকনিকের ভিডিও পেতে ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট হন্যে হয়ে ঘুরেছিল। যিনি অনেকটা বলেকয়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন। সমালোচনাকে ভয় না করে তার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এশিয়া কাপে টানা চারটি হাফ সেঞ্চুরি করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। যার ছক্কায় ইংল্যান্ডের স্টেডিয়ামের ছাদ ধসে পড়েছিল।
উদ্বোধনী জুটিতে আরও পরিণত হিসেবে অভিজ্ঞ তামিম ইকবালের পাশে খেলবেন নিজের জাত চেনানো এনামুল হক বিজয়। হয়তো ইংলিশ কন্ডিশনে ওপেনিং জুটিটি আরও মজবুত হবে ওপেনিং লাইনআপে অপেক্ষায় থাকা দেশ সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে।
অতীতের বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবধান অনেক। ২০১৪ সালে যখন বাংলাদেশ পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেরুতে পারছিল না, তখন বাংলাদেশকে নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে উঠেছিল অনেক বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট বোদ্ধারা। তারাই এখন বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। বুঝতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় পরিবর্তন এসেছে। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ বিশ্বকাপ বাংলাদেশে এলে আর বিস্ময় প্রকাশ করবেন না এই ক্রিকেট বোদ্ধারা।
২০০৭ সালের বিশ্বমঞ্চে টাইগাররা মোট রান করেছিল ১২৭২। নয় ম্যাচ খেলে তাদের ব্যাটিং গড় ছিল ১৪১.৩৩। পরের বিশ্বকাপে (২০১১ সালে) বাংলাদেশকে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। সে আসরে টাইগাররা ছয় ম্যাচ খেলে মোট রান করে ১০১৭। সেবার লাল-সবুজ জার্সিধারিদের ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় ১৬৯.৫০। আর এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মোট রান করেন ১৫৮৫। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় গ্রুপ পর্বের ৫টি এবং কোয়ার্টার ফাইনালের একটি ম্যাচ খেলে টাইগাররা। আর তা থেকেই ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় ২৬৪। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ কতটা এগিয়েছে তা বুঝা যায়।
তবে এমন পরিবর্তনে দলের তরুণ ক্রিকেটারদের অবদান যথেষ্ট। মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান ও তাসকিন আহমেদরা প্রমাণ করেছেন, তারা বাংলাদেশ দলের নতুন অক্সিজেন সিলিন্ডার। রুবেল হোসেন নিজেকে চিনিয়েছেন ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলা তার ক্রিকেট প্রেমের উপর কোনো বৈরী প্রভাব ফেলতে পারেনা।
অন্য দলের মতো হার্ডহিটার, উইকেটে গতির ঝড় তোলা পেসার না থাকলেও টাইগারদের এ দলটার মাঝে দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল ভাবে। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হবে নতুন করে পৃথিবীকে চমক দেখাবার পথযাত্রী।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৪৫ ঘণ্টা, ২৮ মার্চ ২০১৫