ঢাকা: ‘অঘটন’-র ট্যাগ লাগানো থাকে যদি প্রথম জয়ের গায়ে; তাহলে দ্বিতীয় জয়টার আগে কি বিশেষণ লাগাবেন? অন্য কোন সময় হলে অবলীলায় লিখে দেওয়া যেতো একগুচ্ছ শব্দ-‘অবিশ্বাস্য!’ ‘অকল্পনীয়!’‘ অবিস্মরণীয়!’ কিন্তু বাংলাদেশ যে তার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সময় পার করছে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে এই জয়টার সঙ্গে ওই শব্দগুলোকে একটু বেমানান-ই মনে হচ্ছে।
কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭৯ রানের এই জয়টা পেতে কতোটা সময় অপেক্ষা করতে হলো বাংলাদেশকে! পাড়ি দিতে হলো কতোটা পথ! নর্দাম্পটন থেকে ঢাকা। ১৯৯৯ এর ৩১ মে-র পর ২০১৫-র ১৭ এপ্রিল। ৮ হাজার ১৯ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে ৫ হাজার ৭ শ ৯৯ দিনের অপেক্ষার অবসান হলো মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। ’৯৯ এর বিশ্বকাপে সেই জয়ের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় জয় পেলো বাংলাদেশ। এবং জয়টা এলো একটা ঐতিহাসিক দিনে। ১৯৭১ সালের এই দিনে এই পাকিস্তানের বিপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। সেই ‘মুজিব নগর দিবস’-র কথা স্মরণ করলে এই জয়টার গায়ে লাগিয়ে দেয়া যায় ‘ঐতিহাসিক জয়’।
ইতিহাস, রাজনীতি সব কিছুকে দূরে সরিয়ে রেখে শুধু ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যায় এ জয়টাকে ঐতিহাসিক-ই বলতে হবে। কারণ, এই জয় বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অন্যভাবে সমৃদ্ধ করলো। সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ইতিহাস গড়লো। ওয়ানডে ইতিহাসে বাংলাদেশ তার দলীয় সবোর্চ্চ রানের স্কোর গড়লো। ৩২৯ রানের ইনিংস দাঁড় করানোর পথে বাংলাদেশ পেছনে ফেললো তাদের আগের সেই ২২৬ রানের ইনিংসকে। কাকতলীয়ভাবে ওই স্কোরটাও বাংলাদেশ দাঁড় করিয়েছিল এই পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৪ সালে এই মিরপুরে এশিয়া কাপে। ইতিহাসের পরিধিটা শুধু সেখানেই আটকে থাকলো না।
এর আগে কখনো বাংলাদেশের কোন ওয়ানডে ইনিংসে দু’টো সেঞ্চুরি দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। এবার দেখলো। এবং সেই সেঞ্চুরি এলো তামিম আর মুশফিকের ব্যাট থেকে। বাংলাদেশের ক্রিকেট সমৃদ্ধ হওয়ার দিনে অ্যাকশান শুধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন হলো পাকিস্তানি অফ স্পিনার সাঈদ আজমলের। আর সেই ম্যাচে সাঈদ আজমলের বোলিং ফিগারের যা চেহারা, তাতে স্পষ্ট হলো, অ্যাকশান শুধরাতে গিয়ে বোলিং এর সেই ‘বিষ্ময়’ হারিয়ে খানিকটা নিঃস্ব হয়েই ফিরলেন তিনি। লাহোর আর লন্ডনে সাকলায়েন মুশতাকের সঙ্গে সপ্তাহ কয়েক নেটে কাটিয়ে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ফেরার সার্টিফিকেট তিনি পেলেন। কিন্তু হারিয়েছেন তিনি অনেক কিছু। যদিও তার প্রথম চার ওভারের স্পেল দেখে মনে হচ্ছিলো সেই পুরনো আজমলই কি নতুন করে ফিরে এলেন! আর মনে হবে না কেন? স্পেলটা দেখুন- ৪-০-৭-০! ২২৯ দিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা অফ স্পিনারের ওই স্পেলটা সত্যি-ই পুরানো দিনকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। যদি কারো মনে সংশয় জাগে তাহলে এই ম্যাচের আগে সাঈদ অজমলের খেলা সবশেষ ওয়ানডের কথাটা একটু মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট শ্রীলংকার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৪ ওভারে ১০ রান দিয়ে মাহেলা জয়াবর্ধনের উইকেটটা নিয়েছিলেন তিনি। সেই সাঈদ আজমলের এই ম্যাচের বোলিং ফিগার সত্যিই বিষ্ময়কর! ১০-০-৭৪-০!
বিষ্ময়ের আরো অনেক কিছু আছে। বাংলাদেশের ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ১৮ রান এলো যে ওভারে সেই ওভারটা করেছিলেন যিনি তার নামও সাঈদ আজমল। তামিম আর মুশফিক শুধু তার এক ওভারে ১৮ রান নিয়ে বসে থাকলেন না। দু’জনে যেভাবে নিজেদের ইনিংসে তিন অংকের ফিগারে পৌঁছালেন, সেখানেও জড়িয়ে থাকলো আজমলের নাম। দু’জনেই সেঞ্চুরি করলেন তার বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে! তামিম তুলে নিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম। ১৩৫ বলে ১৩২ রানের ইনিংস খেললেন বাঁহাতি এই ওপেনার। বেশ ক’টা ম্যাচে খারাপ সময পার করেছেন তিনি। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রানের ইনিংসটা বাদ দিলে তাঁর ব্যাটে রান ছিল না বলা যায়। বাকি ম্যাচগুলোতে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ১৯,০, ২. ১৩, ২৫। স্কোরগুলো তামিমের নামের সঙ্গে একটু বেমানান-ই ছিলো। তাই কথাও হয়েছে অনেক। সাঈদ আজমলের বল ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পৌঁছাতেই তামিম গ্যালারির দিকে তাকিয়ে যে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করলেন, তার ভাবার্থ দাঁড়ায়; অনেক কথা বলেছেন! এবার মুখ বন্ধ করুন। আপতত সমালোচকদের মুখতো বন্ধ রাখতেই হবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের দিনে দুর্দান্ত এক ইনিংস সমালোচকদের জন্য জবাব ছাড়া আর কি?
কিন্তু নীরবে আর এক জনের ব্যাট অনেক কিছুর জবাব দিয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। গত ষোল মাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান বলা যায় তাকে। অনেকগুলো ভাল ইনিংস খেলেছেন। সেঞ্চুরির কাছাকাছি গেছেন। কিন্তু তিন অংকের দেখা পাননি। বরং বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উইকেটের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মাহমুদউল্ল্যার অসাধারণ সেঞ্চুরি দেখেছেন মুশফিক। এই মুর্হুতে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনে ‘মিস্টার কনসিসটেন্ট’ মুশফিকুর রহিম পাকিস্তানের বিপক্ষেই করলেন তাঁর তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ৭৭ বলে ১০৬ রানের ইনিংস খেললেন এই উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। তিনিও সেঞ্চুরিটা করলেন সেই সাঈদ আজমলের বলে বাউন্ডারি মেরে। বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে অন্যতম দাপুটে ইনিংস বলতে হবে এটাকে। ওহাব রিয়াজ, জুনায়েদ খান, রাহাত আলীদের মতো ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে যেভাবে স্ট্রোক খেলেছেন মুশফিক সেটা দেখার জন্য যথেষ্ট ভাল দৃশ্য।
কিন্তু বাংলাদেশের তাসিকন-আরাফাত-সানি যেভাবে পাকিস্তানের ইনিংসটাকে ২৫০ রানে গুটিয়ে দিলেন এবং স্কোরবোর্ডে যখন ভেসে উঠলো বাংলাদেশ ‘ওন বাই সেভেনটি নাইন রান’ সেটাও দেখার জন্য দারুণ এক দৃশ্য ছাড়া কি? আর এই দৃশ্যটা দেখার জন্য কতোটা দিন অপেক্ষা করতো হলো বাংলাদেশকে! নর্দাম্পটনে বাংলাদেশের সেই জয়ের স্মৃতিটা আগের দিন যিনি মনে করতে গিয়ে অক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘সেবারের বিশ্বকাপে একটা ম্যাচ খেলেছিলাম আমি। এবং সেই ম্যাচটায় পরাজিত দলের সদস্য হয়েই থাকতে হয়েছিল আমাকে। কারণ; দিনটা ছিল বাংলাদেশের। সব বিভাগেই তারা আমাদের চেয়ে ভাল ক্রিকেট খেলেছিল। ’ কিন্তু এই ম্যাচেও তিনি থাকলেন সেই পরাজিত দলের ড্রেসিং রুমে। আর সেই ম্যাচে যিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ছিলেন তিনি থাকলেন এবারও জয়ী দলে।
তবে দু’জনে অন্য ভুমিকায়। ওয়াকার ইউনিস পাকিস্তানের কোচ। আর খালেদ মাহমুদ সুজন বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার। তবে এই ম্যাচ শেষ তাদের কাউকে বলতে হবে না, বাংলাদেশ কেমন ক্রিকেট খেলেছে। সাকিব সিরিজ শুরুর আগে কেন নিজেদের ফেবারিট বলেছিলেন; তা মিরপুর স্টেডিয়ামের বাইশ গজে দেখিয়ে দিলেন তার টিমমেটরা।
সাকিবের নেতৃত্বে এই জয় পরের ম্যাচে বাড়তি চাপে ফেলে দিলো কি বাংলাদেশ দলের নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে? হয়তো বা। হয়তো না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে চাপেই থাকবে পাকিস্তান। কারণ, ফেবারিটের মতো শুরু করলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৫
আরএ