ফতুল্লা থেকে: ফ্লাডলাইটে টেস্ট ক্রিকেট! বিস্মিত হচ্ছেন? বিস্ময়ের কিছু নেই। ক্রিকেট নামক খেলাটার যেভাবে সংস্কার হচ্ছে, তাতে আগামীতে ফ্লাডলাইটের আলোয় সাদা বলে টেস্ট ক্রিকেট হতেই পারে।
দিনের প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই জ্বলে উঠেছে ফ্লাডলাইট। বৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে দিনের ৩৪টা ওভার। দিন শেষে ভারত স্কোর বোর্ডে জমা করেছে ২৩৯ রান। আর বাড়তি তথ্য হিসেবে যোগ করতে হচ্ছে স্কোরটা করেছে তারা কোনো উইকেট না হারিয়ে। এটা যদি হয় প্রথম দিন শেষে ম্যাচের সংক্ষিপ্ত চেহারা, তাহলে আগামী দিনে কি ঘটতে পারে তা নিয়ে যে যার মতো চিন্তা করতেই পারেন।
তবে দুশ্চিন্তার কিছু আপাত দেখছেন না বাংলাদেশ কোচ। স্বপ্নের ফেরিওয়ালার মতো দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে স্বপ্ন ফেরি করে গেলেন হাথুরুসিংহে। ‘এখনো আমরা জয়ের কথাই ভাবছি। ’ বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ কোচের বিশ্বাস এখান থেকে এখনো ম্যাচ জেতা সম্ভব! হয়তো সম্ভব। তবে বাংলাদেশ কোচ যে ‘তত্ত্ব’-র চাবি দিয়ে সেই সম্ভাবনার দরোজা খুলতে চাইছেন সেটা অনেক পুরনো, মরচে ধরা। বলা যায় প্রায় অচল। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের ক্রিকেট চিন্তা দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে টেস্ট জেতা কি সম্ভব?
যদি সম্ভব হতো তাহলে ভারতীয় দলের প্রথম একাদশটা পাঁচ বোলার আর ছয় ব্যাটসম্যান নিয়ে হতো না। আর ভারতের সেই পাঁচ বোলারের তালিকায় তিন পেসার আর দুই অফ স্পিনার থাকতো না। তবে হাথুরুসিংহে যে একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ফিরিয়ে আনলেন ষাটের দশকের ভারতীয় ক্রিকেটকে! হ্যাঁ, ভারত যতোই তিন পেসার আর দুই অফ স্পিনার খেলাক না কেন; বাংলাদেশ কিন্তু এক পেসার আর চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নেমেছে। যদি কারো মনে প্রশ্ন জাগে, এতে ষাটের দশকের ভারতীয় ক্রিকেটের ছোঁয়া কোথায়?
তাদের জন্য লিখতে হচ্ছে; ১৯৬৭ তে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বার্মিহংহাম টেস্টে ভারত তাদের চার বিখ্যাত স্পিনার চন্দ্র শেখর, বেদি, প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটকে নিয়ে একাদশ সাজিয়েছিল। আর নতুন বলটা অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি তুলে দিয়েছিলেন ভি সুভ্রামনিয়াম ও বিকে কুন্দরনের হাতে। এদের মধ্যে প্রথম জন মূলত লেট মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। আর কুন্দরণ ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
প্রথম ইনিংসে এই দু’জনের বোলিং ফিগার ছিল যথাক্রমে ১০-২-২৮-০ এবং ৪-০১৩-০। আর ভারতের সেই বিখ্যাত স্পিন চতুষ্টয়ের প্রথম ইনিংসের বোলিং ফিগার ছিলো বেদি: ২৭-৬-৭৬-৩, চন্দ্র শেখর : ৩২-৮-৯৪-৩, ভেঙ্কট: ১৩-৩-২৬-২ এবং প্রসন্ন: ২০-৫-৫১-৩। আর ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে করেছিলো ২৯৪ রান।
বাংলাদেশ-ভারত প্রথম টেস্টের প্রথম দিন শেষে ৪৮ বছর আগের ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের স্কোর কার্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কেন? তার উত্তরটা দেওয়া জরুরি। কারণ ওই চার স্পিনারের জন্যই ভারতের স্পিন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়েছিলো। যে ঐতিহ্যের কথা বলতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে কয়েক মাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেমন বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার যেমন আছে ফাস্ট বোলিংয়ের ঐতিহ্য, ভারতের আছে স্পিন বোলিংয়ের ঐতিহ্য। ’
যাদের হাত ধরে ভারতীয় স্পিনের সমৃদ্ধি, সেই চার স্পিনার একসঙ্গে মাত্র ওই একটি টেস্টই খেলেছিলেন। এবং সেই ম্যাচটা ভারত হেরেছিলো। আর বাংলাদেশ এই টেস্টে যে একাদশ নামিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ভারতের সেই ঐতিহ্যের পুরনো পতাকাই ওড়াতে চাইছে স্বাগতিকরা! তা নাহলে চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নামবে কেন?
নামার যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশ কোচ বললেন, এই উইকেটে এটাই আমাদের সঠিক কম্বিনেশন। ’ সত্যিই কি তাই? স্পিন বাংলাদেশ বোলিংয়ের শক্তি ঠিকই। কিন্তু তাই বলে এক পেসার! এর আগেও শ্রীলংকার বিপক্ষে ২০১৪ সালে এক পেসার নিয়ে খেলেছিলো বাংলাদেশ। সেই টেস্টটা ড্রও করেছিলো। তারপরও কি এই চার স্পিনার এক পেসারের কম্বিনেশনকে সঠিক দাবি করবেন? অবশ্য করা যেতেই পারে। কারণ, বাংলাদেশ দলের বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকতো সৌম্য সরকারকে ‘জ্যাক কালিস’ বানিয়ে ফেলেছেন!
আর প্রথম দিনে বাংলাদেশের সেই ক্যালিসকে দিয়ে মাত্র ২ ওভার বল করিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ২ ওভারে ৭ রান দেওয়ার পর তাকে সরিয়ে ইংনিসের ৬ষ্ঠ ওভারেই অফ স্পিনার হিসেবে দলে জায়গা পাওয়া শুভাগত হোমকে আক্রমণে নিয়ে আসেন অধিনায়ক। শুভাগত ১৩ ওভারে ৪১ রান দিয়ে অবশ্য কোনো উইকেট পাননি। পাবেন কীভাবে, ভারতীয় ইনিংসে এখনো যে কোন উইকেটই পড়েনি। দিন শেষে স্কোরবোর্ডের অন্যরকম চেহারা দেখার সুযোগ অবশ্য এসেছিলো বাংলাদেশের সামনে।
বাঁ হাতি স্পিনার তাইজুলের বলে শিখর ধাওয়ান ৭৩ রানে শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন। সেটা ড্রপ করেছেন শুভাগত। আর শিখর দিন শেষে ১৫০ রানে অপরাজিত আছেন। তার সঙ্গী হিসেবে মুরালি বিজয় আছেন সেঞ্চুরি থেকে ১১ রান দূরে দাঁড়িয়ে। চার স্পিনার নিয়ে একাদশ গড়লেও শেষ পর্যন্ত ইমরুল কায়েসের অকেশনাল অফ স্পিনের ওপরও ভরসা রাখতে হয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়ককে!
সাকিব এবং তাইজুল দুই বাঁহাতি স্পিনারের সঙ্গে লেগ স্পিনার জুবায়ের আর অফ স্পিনার শুভাগত হোমকে দলে রাখা হয়েছে স্পিন অ্যাটাকে বৈচিত্র আনার জন্য। কাগজে -কলমে বৈচিত্র্য অবশ্যই আছে। কিন্তু ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা যে স্পিন ভালো খেলেন সেটা বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট জানে না তা বলবেন কীভাবে! কিন্তু তারা যা বলছেন সেটাই বা মানবেন কীভাবে?
ফতুল্লার উইকেটে ভারতীয়দের বিপক্ষে চার স্পিনার সঠিক কম্বিনেশন! প্রথম দিন শেষে সেটা সঠিক ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু হাথুরুসিংহে যে এখনো ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন! দলে চার স্পিনার দেখে আপনি আমি বিস্মিত হচ্ছি-ই বা কীভাবে!
তবে ফতুল্লায় কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে আগামী দিনে কে জানে। অবশ্য একটা কথা জানা। ভারত তাদের বিখ্যাত চার স্পিনারকে একসঙ্গে যে টেস্টটায় খেলিয়েছিলো সেটা তারা হেরেছিল ১৩২ রানে। ভারত পারেনি। বাংলাদেশ পারলে বিস্মিত হবে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
এএ