কক্সবাজার থেকে ফিরে: বাবা-মায়ের চোখে সব সন্তানই পৃথিবীর সেরা। সন্তানের সাফল্য যখন বাবা-মায়ের মনে গর্বের অনুভূতি সঞ্চার করে তখন সেটি হয় সুখি পরিবারের একটি।
এ গল্প তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানতেই ০১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে অটোবাইকে চড়ে রওয়ানা হলাম মুমিনুল হকের বাড়ির দিকে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বৈদ্যেরঘোনায় মুমিনুল হকের বাড়িতে যখন পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুইটা ছুইছুই। দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ না হতেই এঁটো হাতে সদর দরজার দিকে এগিয়ে এলেন মুমিনুলের বাবা নাজমুল হক। দুপুরের খাবার তার বাসায় খাওয়ার অনুরোধ রাখা গেল না। তবে চা-বিস্কুট খাওয়ার আবদার রাখতেই হলো। চা আসার আগে মুমিনুলের বাবা নাজমুল হক বলছিলেন, ‘তোমরা আমার ছেলের মতো। তাছাড়া মুমিনুলের শুভাকাঙ্খী তোমরা। ’
ড্রয়িং রুমে চা খেতে খেতে মুমিনুল প্রসঙ্গে জমলো আড্ডা। যাকে নিয়ে আড্ডা সেই মুমিনুল হক তখন মিরপুরে অনুশীলনে ব্যস্ত ইংল্যান্ড সিরিজে চোখ রেখে। বাবা নাজমুল হক বললেন, ‘একটু আগেই মুমিনুলের সঙ্গে কথা হলো প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছে। সবাই তো ওকে টেস্ট প্লেয়ার বলে। ওয়ানডে টিমে ঢোকার জন্য অনেক কষ্ট করে যাচ্ছে ছেলেটা। প্রিমিয়ার লিগে তো ভালোই করেছে। কোচ-নির্বাচকরা যদি চায় ওয়ানডে দলে আসতেও পারে। তবে ওসব নিয়ে আফসোস নেই আমার ছেলের। কোনোদিন অভিযোগ শুনিনি ওর থেকে। অনেক ধৈর্য ওর। ’
ক্রিকেটীয় আলাপ যখন জমতে শুরু করেছে তখন ড্রয়িং রুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে মুমিনুলের মা। ছেলের গল্প শুনছিলেন মালেকা জয়নাব। মা’কে ঘিরেই মুমিনুলের জীবনের সব হাসি-কান্না। মায়েরও ঠিক তাই। মুমিনুলকে নিয়ে নাজমুল হক গর্ব নিয়ে নানান কথা বলে যাচ্ছেন আবেগ ধরে রাখা হাসি নিয়ে মাথা ঝাঁকছেন মালেকা জয়নাব। কথার সঙ্গে সায় দিয়ে যাচ্ছেন বার বার। ছেলেকে নিয়ে গর্বের দ্যূতি ছড়াচ্ছে চোখে-মুখে। কথা বলার চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন।
৫ বছর ধরে মুখে কথা নেই মুমিনুল হকের মায়ের। ব্রেইন স্ট্রোকের পর থেকে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। দিনটি ছিল ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর। মুমিনুল তখন ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। ওই দিনটিতেই ১৫০ রানের ইনিংস খেললেন মুমিনুল। রাতে মুমিনুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলে খুশি মনেই ঘুমোতে গেলেন মালেকা। ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় নাজমুল হকের। পাশে দেখেন কোনো নড়চড় নেই তার স্ত্রীর। নিথর দেহ, কোনো সাড়া নেই। পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললেন বড় ছেলে শাওনকে। দ্রুত পৌঁছালেন হাসপাতালে। চিকিৎসক জানালেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। সোজা নিয়ে আসা হলো রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে। তখনো মুমিনুলকে জানানো হয়নি তার মা অসুস্থ। কারণ, খেলায় প্রভাব পড়তে পারে।
এদিকে, চিকিৎসার খরচ কিভাবে মিলবে- এ নিয়ে চিন্তায় শাওন ও তার বাবা। সিদ্ধান্ত নিলেন জায়গা বিক্রি করবেন। এর মধ্যে কেটে গেল ১৪ দিন। মালেকা তখনো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। মুমিনুল দেশে ফিরলেন। মায়ের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) খেলোয়াড়দের নিলাম চলছে। বরিশাল বার্নার্সে ডাক পড়লো ১৯ বছরের তরুণ ক্রিকেটার মুমিনুল হকের। পেলেন ৮ লাখ টাকা। পুরো টাকাই তুলে দিলেন বাবার হাতে। সেই থেকে এখন অবধি মায়ের সব চিকিৎসা ব্যয় বহন করেন মুমিনুল। পরিবারের সঙ্গেই আটকে রাখেন নিজেকে।
মুমিনুলের মা এখন হাঁটাচলা করতে পারেন স্বাভাবিকভাবে। কথাটাই বলতে পারেন না। ডাক্তার বলেছেন আর কোনো দিন কথা বলতে পারবেন না মালেকা জয়নাব। মুমিনুলের যু্দ্ধটা তাই চলছেই। মাকে সবসময় ভালো রাখার, খুশি রাখার প্রয়াস তার।
রাজধানীর বসুন্ধরায় মুমিনুলের এখন নিজস্ব ফ্ল্যাট। সুযোগ পেলেই ঢাকায় এসে বেড়িয়ে যান মুমিনুলের বাবা-মা। ছোট ছেলের পাশে থাকার টান অনুভব করেন তারাও। ক্রিকেটের ব্যস্ততায় ঈদ ছাড়া কক্সবাজারে খুবই কমই যাওয়া হয় মুমিনুলের। সেটি বুঝে বাবা-মাই চলে আসেন ঢাকায়। বড় ভাই শাওনের সঙ্গে দারুণ মিল মুমিনুলের। কক্সবাজারে গেলে ভাতিজাকে নিয়েই মেতে থাকেন মুমিনুল। সুখি পরিবার তো একেই বলে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৬
এসকে/এমআরএম