বিষয়টি বেশি চোখে পড়তে শুরু করেছে চলতি বছরের শুরুতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। সেই থেকে আজ অবধি খেলা চার টেস্টের মোট ৮ ইনিংসে একটিতেও দলীয় ২শ’ রান সংগ্রহ করতে পারেনি বাংলাদেশ দল।
তার ওপরে আবার সম্প্রতি যোগ হয়েছে জিম্বাবুয়ের মতো দলের কাছে নির্মম হারের অভিজ্ঞতা। গেল ১৭ বছর যে দলটি দেশের বাইরে একটি জয়ের উপাখ্যানও রচনা করতে পারেনি তাদের কাছেই কি না প্রথম টেস্টে ১৫১ রানে হেরেছে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দেয়া স্বাগতিক বাংলাদেশ!
এরপরেও হতাশ হওয়া বা মুষড়ে পড়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে করেন না টাইগার টেস্ট দলপতি সাকিব আল হাসান। তিনি মনে করেন সাদা পোশাকে তারা ঠিক পথেই আছেন। সাকিবের অকাট্য যুক্তিও হলো, ১৮ বছরে যে কয়টি (১০৯) টেস্ট ম্যাচ বাংলাদেশ খেলেছে, পারফরম্যান্সের উন্নতির রেখা ঊর্ধ্বমুখী করতে সেগুলো সংখ্যায় মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে হারানো এবং শ্রীলঙ্কায় গিয়ে শততম টেস্টে তাদের হারানো সে-ই বা কম কিসে?
বাংলানিউজকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন কথাই বললেন বাংলাদেশ টেস্ট ও টে-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। কথা বলেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয় নিয়েও। পাঠকদের জন্য সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে ১৮ বছর হয়ে গেল। যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিলো সেখানে কী পৌঁছাতে পেরেছে?
সাকিব: আরও ভালো অবস্থানে থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। তারপরেও আমি বলবো খুব একটা আমরা পিছিয়ে নেই। কারণ বিগত বছরগুলোতে আমরা মাত্র কয়েকটা টেস্ট খেলেছি। আমাদের জায়গাটাও কখনো আমরা সেভাবে তৈরি করতে পারিনি কিংবা আমাদের ফোকাসটাও ওইদিকে খুব একটা ছিলো না যে, টেস্টে আমরা ভালো দল হয়ে উঠবো। যদি ফোকাসটা থাকতো আমি নিশ্চিত আরেকটু ভালো হতো। তারপরেও আমি বলবো আমরা সঠিক পথেই আছি।
বাংলানিউজ: ফোকাসের কথা বলছিলেন, ওয়ানডেতে ফোকাস থাকলেও টেস্টে কেন থাকতে পারেন না?
সাকিব: টেস্ট কিন্তু আমরা খারাপ করিনি। আমরা এর ভেতরে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে দেশের মাটিতে হারালাম। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তাদের হারালাম। হ্যাঁ, শেষ কয়েকটি টেস্ট অবশ্যই আমরা ভালো করিনি। কিছু কিছু জায়গাতে আমাদের অনেক কাজ করার আছে। তার ওপর আরেকটা ব্যাপার হলো দেশের বাইরে গিয়ে কোনো দলই খুব একটা ভালো খেলছে না। আপনি রেকর্ড দেখেন কিংবা শেষ কয়েক বছরের পারফরম্যান্স দেখেন। আপনি ভারতকে দেখেন। ওরা যখন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাতে যায়, এত ভাল দল, এত নামকরা সব প্লেয়ার, ওদেরও কিন্তু সংগ্রাম করতে হয়। শুধু আমাদের বললে ভুল হবে যে, আমরা কেন ভাল করতে পারছি না। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে হারানো আমাদের অনেক বড় অর্জন। আমি বলবো না আমরা খারাপ অবস্থায় আছি। বরং আমরা অনেক ভালো অবস্থায় আছি। ক্রিকেট খেলাটাই এমন। মাঝে মাঝে খারাপ সময় আসতেই পারে।
বাংলানিউজ: কিন্তু আমরা যদি শেষ ৮ ইনিংস দেখি সেখানে আপনারা দলীয় ২০০ রান করতে পারেননি। এটা কতটা হতাশার?
সাকিব: এটা একটা অবশ্যই খারাপ দিক যে, ব্যাটিংয়ে আমরা টানা এতগুলো ইনিংস ব্যর্থ হয়েছি। এখানে আমাদের অবশ্যই উন্নতির জায়গা আছে। কিন্তু এরসাথে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে আমরা কোন কন্ডিশনে খেলেছি, কোন দলগুলোর বিপক্ষে খেলেছি। তবে দলের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো কোন কন্ডিশনে খেলেছি। আমরা যতগুলো টেস্ট ম্যাচই খেলেছি লো স্কোরিং ছিলো এবং উইকেটগুলো ওরকম ছিলো না। এটা ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন। এগুলো সবাই বুঝবেও না, সবার বোঝার জন্যও না। যাদের ধারণা আছে তারাই কেবল এগুলো বুঝতে পারবে। তাই আমি মনে করি না এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু আছে। যদি ভালো উইকেট পাই ব্যাটসম্যানরা অবশ্যই রান করবে। তখন দেখবেন বোলাররা ভালো বোলিং করছে না। তখন বোলারদের ওপর বিরক্তি এসে যাবে। এগুলোর সবকিছুরই একটা ভারসাম্য থাকে। আমরা এগুলো বুঝি এবং জানি। এজন্যই এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি। শুধু একটা ম্যাচে খারাপ ফলাফল দেখে সেটা নিয়ে কোনো যাচাই-বাছাই না করে মন্তব্য করা মনে হয় না ঠিক।
বাংলানিউজ: একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জন্য টি-টোয়েন্টি লিগগুলো খেলা কতটা জরুরি?
সাকিব: অনেক জরুরি। কেননা ওখানে যে ধরনের এক্সপোজার পাওয়া যায় ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় সেটা অমূল্য। ধরেন যদি আমি সারাবছর অনুশীলন করি, ম্যাচ না খেলি তবে আমার যে অভিজ্ঞতা হবে না, সেই অভিজ্ঞতাটা হবে আমি যতগুলো ম্যাচ খেলবো সেটা দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই যত ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে তত খেলা ভালো হবে। আর ওই ধরনের খেলাগুলো অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ থাকে। কিছু না হোক আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, চ্যালেঞ্জিং মুহূর্ত বেশি আসে এবং প্রত্যাশাও বেশি থাকে। ওইগুলোর সাথে যখন খাপ খাওয়ানো যায় তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আরও সহজ হয়ে যায়।
বাংলানিউজ: ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে মনে হয়, আপনি অপূর্ণ?
সাকিব: না।
বাংলানিউজ: তারকা খ্যাতি কতটা উপভোগ করেন?
সাকিব: অনেক।
বাংলানিউজ: দীর্ঘ সময়ের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আপনি। সম্প্রতি রশিদ খান আপনার ওই জায়গাটি (ওয়ানডে ফরম্যাট) নিয়েছেন। মনের অজান্তে হলেও নিশ্চয়ই হারানো র্যাংকিং ফিরে পেতে চান। সেই লক্ষ্যে কতটুকু সিরিয়াস?
সাকিব: মনের অজান্তে কখনোই কাজ করে না এটা। কারণ হচ্ছে আমার ফোকাস কিংবা টার্গেট একটাই থাকে যে আমি যখন একটা দলের হয়ে খেলি কীভাবে সেই দলের জন্য অবদান রাখেতে পারি। দলটাকে জেতানোর জন্য, সেই অবদান যদি বেশি হয় এবং নিয়মিত হতে থাকে তখন এগুলো এমনিতেই চলে আসে। তাই এগুলো নিয়ে আমি কখনো চিন্তা করিনি এবং এগুলো ভেবে ক্রিকেটও খেলি না।
বাংলানিউজ: আপনার ইনজুরি পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু কথা মিডিয়াতে চাউর হয়েছে। সেটা নিয়ে আপনি কতটুকু বিব্রত?
সাকিব: আমাকে বিব্রত করে না। এটা যারা করে তাদের জন্য বিব্রতকর একটা বিষয়। অন্তত একটা বিষয় আপনাদের মিডিয়ার নিশ্চিত করা উচিত যে, সঠিক তথ্যটা যেন মানুষ পায়। এটা একটা অনুরোধ থাকবে। আমার জন্য মোটেও বিব্রতকর না। কারণ আমি জানি আমি কী বলেছি, কী করেছি। আমার তো লুকানোর কিছু নেই। যে ঠিক কাজ করবে তার তো লুকানোর নেই কিছু।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের আগামীর ক্রিকেটকে কেমন দেখছেন? মানে আপনার চোখে আগামীর বাংলাদেশের ক্রিকেট কতটুকু উজ্জ্বল?
সাকিব: খুবই উজ্জ্বল আমি মনে করি। যেভাবে আমরা আগাচ্ছি, শেষ আট, দশ বছর আমাদের যে উন্নতি, এরকম আগামী ১০ বছর ধরে রাখতে পারলে আমরা কোথায় যাব আপনিও অনুমান করতে পারেন সেটা। আমি তো খুবই আশাবাদী। কিন্তু এটাও ঠিক সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। সেটা আসলে কেউই বলতে পারবে না।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের পাইপলাইন কতুটু সমৃদ্ধ বলে মনে করেন?
সাকিব: এই বিষয়ে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। তবে আমি মনে করি আমাদের পর্যাপ্ত প্লেয়ার তৈরি হচ্ছে। ক্রিকেট খেলা তো অনেক হচ্ছে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট চলছে। সবসময় কোনো না কোনো খেলা হচ্ছে। যতবেশি খেলা হবে ততবেশি খেলোয়াড় তৈরি হবে।
বাংলানিউজ: মাশরাফি ছাড়া ভালো মানের সিমার আমাদের কমই আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটের অধিনায়ক হিসেবে আপনি কি মনে করেন বিসিবিকে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত?
সাকিব: আমি তো মনে করি আমাদের পর্যাপ্ত বোলার আছে। সময় দিতে হবে যাতে করে ওরা ওদের প্রতিভা দেখাতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের পর্যাপ্ত সিমার আছে।
বাংলানিউজ: ইনজুরির কারণে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে সিরিজটি খেলতে পারছেন না, খারাপ লাগে?
সাকিব: একটু তো খারাপ লাগেই। তবে ইনজুরি কিন্তু খেলারই অংশ।
বাংলানিউজ: ইনজুরি একজন ক্রিকেটারকে কী শিক্ষা দেয়?
সাকিব: সঠিক বলতে পারবো না আসলে কী শিক্ষা দেয়। কিন্তু এটা ঠিক অনেক কিছু চিন্তা করার জন্য সময় পাওয়া যায়। যেহেতু খেলার মধ্যে থাকলে চিন্তার সেই সুযোগ পাওয়া যায় না। তাই ইনজুরিকালীন সময়ে সেই চিন্তাটা করা যায়।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ দলে একজন কোয়ালিটি লেগ স্পিনার নেই। যুবায়ের হোসেন লিখন ছিলেন, কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। ওর মতো লেগিকে আমরা কেন সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না?
সাকিব: ও যদি ভালো বোলিং করতে পারতো কিংবা ও যদি দলের সাথে থাকতে পারতো আমার মনে হয় খুবই ভালো হতো। যেহেতু ওরকম কিছু করতে পারছে না বা ওরকম কিছু করেনি তাই কেউ ওকে দলেও রাখতে পারছে না। তবে লেগ স্পিনার থাকলে ভালো হতো। কিন্তু নাই বলেই যে কাউকে খেলানো সম্ভব হবে না তা না। ভালো একজন পাওয়া গেলে অবশ্যই সে খেলবে। আমি মনে করি যুবায়েরের ভেতরে অনেক প্রতিভা ছিলো এবং আছে। এখনও সময় আছে, ও যদি এক দুই বছরের মধ্যে ঠিকভাবে দলে আসতে পারে আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের জন্যই ভালো হবে।
বাংলানিউজ: বড় বড় টুর্নামেন্টে আপনারা খুব কাছে এসে হেরে যান। এটা কেন হয়?
সাকিব: উত্তরটার যদি জানতাম তাহলে তো আর হারতাম না, জিততামই (হাসি)। অনেক ক্লোজ ম্যাচ আছে যেগুলো আমরা জিতেছি, সেগুলো নিয়ে আমরা আসলে কথা বলি না। আমরা যদি আফগানিস্তানের সঙ্গে ম্যাচটির কথা ধরি (এশিয়া কাপ), মোস্তাফিজ শেষ ওভারে আট রান দিল না। আমরা যদি ওই ম্যাচটা না জিতে হেরে যেতাম বলতেন মানসিক সমস্যা। জিতলাম, ওটা কি আমাদের মানসিক উন্নতি না? আসলে এগুলো হচ্ছে আমাদের চিন্তাধারার ব্যাপার। চিন্তা যদি ইতিবাচক করি ভালো জিনিসগুলো দেখতে পাব। আর চিন্তা নেতিবাচক হলে নেতিবাচকভাবে দেখবো।
বাংলানিউজ: ক্রিকেট কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিশ্বের অনেক দেশেই আপনি গিয়েছেন, থেকেছেন। বেড়ানোর জন্য আপনার চোখে আপনার প্রিয় শহর কোনটিকে মনে হয়েছে?
সাকিব: যেখানেই থাকি, আমার ভালো লাগে। ঘুরতে ভালো লাগে, বাসায় থাকতেও ভালো লাগে। যেহেতু বাইরে বাইরে থাকা হয় তাই মাগুরা গেলে বেশি ভালো লাগে। ঢাকা থাকতেও ভালো লাগে।
বাংলানিউজ: সম্প্রতি স্টিভ রোডস বলেছেন আপনি এদেশের সবচাইতে কৌশলী অধিনায়ক। হেড কোচের মুখ থেকে এমন প্রশংসা আপনাকে কতটুকু উজ্জীবিত করে?
সাকিব: অবশ্যই ভালো লাগে কোনো ইতিবাচক কথা শুনলে। একটি কমপ্লিমেন্ট অবশ্যই আমার জন্য ভালোলাগার বিষয়। চেষ্টা থাকবে যেন আরও ভালো কিছু করতে পারি। যেন এই কথার মান রাখতে পারি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, ০৯ নভেম্বর, ২০১৮
এইচএল/এমএমএস/এমজেএফ