ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

গ্রামের সহজ সরল মানুষটি মামলার আসামি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৩
গ্রামের সহজ সরল মানুষটি মামলার আসামি শ্যামল দত্ত (লালু)

চট্টগ্রাম: বোয়ালখালী পৌরসভার পূর্ব গোমদণ্ডী দত্তপাড়া গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গৃহস্থালি কাজের জন্য ডাক পড়ে তার। কাঠ কাটা, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করা, সামাজিক-পারিবারিক উৎসব আয়োজন তাকে ছাড়া হয় না।

সহজ সরল সাদাসিধে স্বভাবের মানুষটির নাম শ্যামল দত্ত। তবে লালু নামেই বেশ পরিচিতি তার।

দুর্ভাগ্যবশত, অপরাধ না করেও লালু এখন আসামি। গ্রামের এক পরিবারের অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ করতে গিয়ে তাকে করা হয়েছে মামলা আসামি। ৪৪ বছর বয়সী লালু পূর্ব গোমদণ্ডী দত্তপাড়ার মৃত নিরোধ দত্তের ছেলে। তার সংসারে আছে দুই কন্যা।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লালু তার পাশের এক বাড়িতে সকালে কাজে যান। ওই বাড়িতে কাজ করার সময় শ্রীবাস বিশ্বাস ও মেরী বিশ্বাস হামলা চালিয়ে শ্যামল বিশ্বাসকে আহত করেন। এ ঘটনায় হতবিহ্বল লালু ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়।  

আহত শ্যামল বিশ্বাস হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বোয়ালখালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। সেখানে লালুর নাম নেই। এরপর মেরী বিশ্বাস বাদী হয়ে ১২ সেপ্টেম্বর লালু সহ ১০ জনকে আসামি করে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বন আদালতে (সিআর-৩০১/২০২২) চাঁদাবাজীসহ জামিন অযোগ্য ৯টি ধারায় অভিযোগ আনেন। মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)।  

প্রায় ৫ মাস তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মোস্তাক আহম্মদ চৌধুরী। দাখিলকৃত প্রতিবেদন লালুকে ২নম্বর আসামি করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে শ্যামল দত্ত লালুসহ ৬ জন আসামি বেআইনীভাবে মেরী বিশ্বাসের জায়গায় গিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, ভাঙচুর করে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি ধমকি প্রদান করে দণ্ডবিধির ৭টি ধারায় অপরাধ করেছেন। যা তদন্তে প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রকাশ পায়।  

তবে এলাকাবাসী বলছেন, গ্রামের সহজ সরল মানুষ লালু শৈশবে মাকে হারিয়েছে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে আবার রেঁধে বেড়ে খাইয়ে তাকে বড় করেছেন বাবা নিরোধ দত্ত ফেলু।  লালুর বাবাও মারা গেছেন। লালু সংসারী হয়েছে। বাবার মতো সে দিনমজুরি করে সংসার চালায়। কারও সাথে উচ্চস্বরে কথাও বলতে জানে না। অথচ তাকেই মামলার আসামি করা হলো। কারও পারিবারিক বিরোধে লালুকে আসামি করাটা ঠিক হয়নি।  

কথা হয় লালুর সাথে। সে জানায়, সারাদিন পরিশ্রম করে যা আয় হয় তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এর মধ্যে শুনছি- মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। গত ১ মার্চ মামলার কাগজ তুলতে একজনকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সেই টাকা যোগাড় করতে দুইদিন একটি দোকানের ইট-সিমেন্ট টেনেছি।  

লালু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কাগজে নাকি লিখেছে-আমি মারধর করেছি। আমি জেলে গেলে আমার মেয়েগুলোকে কে খাওয়াবে? আমি তো বুঝি না এসব কোর্ট-কাচারির বিষয়। মানুষের কাছে গেলে বলছে, কোর্টে যেতে হবে।  

স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর সুনীল চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘লালুকে মামলায় জড়ানো উচিত হয়নি। সে খুব গরিব। দিন এনে দিন খায়। কারও ঝামেলার মধ্যে সে নেই। তাকে মামলায় জড়িয়ে প্রতিপক্ষের কি লাভ হবে বুঝতে পারছি না’।

মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, দেশে অনেক অভিযোগকারীই রয়েছেন, যারা শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যেই মিথ্যা মামলা করে বসেন। অভিযোগ মিথ্যাই হোক আর সত্যই হোক, মামলার ধারা কঠিন হলে, প্রথম অবস্থায় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে জামিন পাওয়া বেশ মুশকিল। দেখা যায়, অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয় যা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। অপরাধ প্রমাণিত না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান। কিন্তু ততদিনে দেখা যায়, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সাজা হিসেবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কারাগারে বসে অতিবাহিত করেন। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যখন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কারাগারে বসে বন্দী হয়ে কাটান- তখন যে কী পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা কেবল সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার ভুক্তভোগী পরিবারই অনুধাবন করতে পারেন, আর কেউ নয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৩ 
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।