ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

অপরাধ তদন্তের পাশাপাশি কবিতা লেখার নেশা

সোহেল সরওয়ার, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৩
অপরাধ তদন্তের পাশাপাশি কবিতা লেখার নেশা ...

চট্টগ্রাম: কখনও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরতে পিছু ছুটতে হয়, কখনও গহীন পাহাড়ে মাটি চাপা দেওয়া কঙ্কাল উদ্ধার করে আনতে হয়। কখনওবা উদঘাটন করতে হয় হত্যা রহস্য, ধরতে হয় প্রতারককে, দায়িত্ব পেয়ে আসামিকে হাজির করতে হয় কাঠগড়ায়।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর কাজই এমন।  শরীর ও মনের ওপর বয়ে যাওয়া এই ঝড় থামে না।

সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ শরীফ এমন বাস্তবতা মেনে নিয়ে মনের খোরাক জোগাতে নিয়মিত লিখছেন কবিতা। ক্ষণিকের অবসরে যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনার কথামালা লিপিবদ্ধ করে চলেছেন ফেসবুকের পাতায়।  

২০০৫ সালে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ও ২ কন্যা নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। কর্মক্ষেত্রে সততা ও সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে অতিরিক্ত আইজিপি কর্তৃক সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১ম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে পেয়েছেন পুরস্কার। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলতে পছন্দ করলেও তাঁর প্রথম পছন্দ-কবিতা লেখা। এজন্য সবসময় অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন ব্যাংকার স্ত্রী খায়রুল জান্নাত মুন্নী।

মুহাম্মদ শরীফ এর কবিতা লেখার এই ঝোঁক প্রশংসিত হয়েছে সহকর্মী এবং সংস্কৃতিমনাদের কাছে। এ পর্যন্ত তিনি লিখেছেন প্রায় দুইশ কবিতা। বিষয়বস্তু: প্রেম, বিরহ, কষ্ট, যাতনা, সংস্কৃতি, নিপীড়ন, শোষণ ও জীবনবোধের নানান অনুষঙ্গ। তবে হাজারও ব্যস্ততায় এখনও বই প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।

মুহাম্মদ শরীফের মতে, কবিতা একটা বোধ ও শব্দের খেলা। তাঁর কাছে কবিতা প্রলুব্ধতার মতো, জিজ্ঞাসার মতো, কবিতা সত্যের মতো। আমরা সব দেখি, বুঝি, অনুভব করি এবং সবকিছু এই কবিতা সৃষ্টির মধ্যেই অনুরণিত হয়। ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের আয়নায় যখন ধরা পড়ে সমাজ মনস্তত্ত্ব, তখন কবিতার খাতাও হয়ে ওঠে সমাজের আয়না। লেখক তখন মানুষের জীবন, স্বপ্ন আর আশাভঙ্গের বিবরণভাষ্য নির্মাণে কবিতার ভাষা বুনন করেন।  

মুহাম্মদ শরীফ কবিতা লেখার মতো দক্ষতা দেখিয়েছেন কর্মজীবনেও। ২০১৬ সালে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ১২ জন দুর্বৃত্ত পিটিয়ে হত্যা করে শাহাদাত হোসেন ছোটন নামে এক যুবককে। হত্যার পর মরদেহ মাটিতে পুঁতে রাখে তারা। এ ঘটনার ১৪ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখা ছোটনের কঙ্কাল উদ্ধার করে সিআইডি। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ শরীফ। তাঁর তদন্তে উদ্ঘাটন হয়, ছিন্নমূল নেতা মশিউরের পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড মশিউরসহ ১৫ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।  

সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা এলাকায় অপহরণের ৪ বছর পর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দীঘিরপার এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধারেও নেতৃত্ব দেন পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ শরীফ। ওই এলাকার নুর আলম মেম্বারের ছেলে আলমগীরের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার জেরে সালাউদ্দিনকে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার দিকে ছোট কুমিরা ইউনিয়নের ত্রিপুরাপাড়া থেকে আসামির স্বীকারোক্তি মোতাবেক মাটি খুঁড়ে কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়।

কম্বোডিয়ায় চাকরি দেওয়ার নাম করে সেখানে লোক পাঠিয়ে পরে তাদেরকে জিম্মি করে টাকা আদায় ও স্ট্যাম্পে সই নেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ইফতেখার আহমেদ খান প্রকাশ রনি নামের একজনকে গ্রেফতার করে এবং আমেরিকাপ্রবাসী নারীর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিদাতা প্রতারককে গ্রেফতার করে প্রশংসিত হন এই সিআইডি কর্মকর্তা।

এছাড়া ২০১৭ সালে সীতাকুণ্ডে জোরপূর্বক একজনের ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার ছিনিয়ে নেওয়ার মামলায় দুই রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার ও গাড়িটি উদ্ধার করে দেন মুহাম্মদ শরীফ। সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকার বাসিন্দা সাদিয়া আক্তারের স্বামী শাহাদাত হোসেনকে ২০১৬ সালের ১০ জুলাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে অপহরণ ঘটনার মামলা সীতাকুণ্ড থানা থেকে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল তদন্তের জন্য সিআইডি চট্টগ্রামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শুরু করেন সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মুহাম্মদ শরীফ। এরপর মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. রানা, মো. সোহেল, মো. কালু ও মশিউর রহমানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডি।

২০১৯ সালের ২৬ জুলাই। মীরসরাই উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপাহাড় এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া রঞ্জন রায় নামের এক তরুণের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। বাবা জ্যোতিষ চন্দ্র রায় বাদী হয়ে মীরসরাই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি’র সূত্র ধরে অপহরণ মামলায় পুলিশের তদন্তে গ্রেফতার হয় ইউনুস মিয়া (১৯) নামের এক রিকশাচালক। খুনের স্বীকারোক্তি দিয়ে ২৬ মাস কারাভোগও করেন তিনি। জামিনে বেরিয়ে এলে নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) উদ্ঘাটন করে মূল রহস্য। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই তরুণ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এতে মুক্তির পথ সুগম হয় সেই রিকশাচালকের।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফ বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছবি দেখে নিখোঁজ তরুণের মা-বাবা শনাক্ত করেন। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা হয়। সেখানেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু।  

২০২১ সালের ২৬ মার্চ হাটহাজারীতে হেফাজত কর্মীদের মিছিল থেকে থানায় হামলা চালানো হয়। উপজেলা ভূমি কার্যালয় এবং সদর ভূমি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানায় দায়ের করা দুই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। দুই মামলায় গ্রেফতার আসামি উপজেলা হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ইমরান শিকদারকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে পাওয়া যায় হামলার পরিকল্পনার বিবরণ।

মুহাম্মদ শরীফ বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি। সবার আগে দেশপ্রেম। আমার দায়িত্ব শতভাগ সততার সাথে পালনের চেষ্টা করছি। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় আমাকে কষ্ট দেয়। সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনির মতো ঘটনা কখনও কাম্য নয়। আমরা ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি প্রতিটি মায়ের কোল হবে নিরাপদ, সমাজে অন্যায়-অনাচার থাকবে না। এমন সুসময়ে অখণ্ড অবসরে বসে লিখবো আনন্দের কবিতা। কারণ কবিতার আরেক নামই-আনন্দ।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৩
এসএস/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।