চট্টগ্রাম: ডলার সংকট, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানান অজুহাতে বেড়েছে ওষুধের দাম। গত তিন মাসে ওষুধভেদে ১০ থেকে ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
এমনিতেই নিত্যপণ্য কিনতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ উপার্জনের বড় অংশ নিজের ও পরিবারের চিকিৎসায় ব্যয় করছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়। এর বাইরে অন্য সব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত দামেই বিক্রি হয়। তবে এই দাম ঠিক করতে যথাযথ যুক্তিসহ অনুমোদনের জন্য অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। আমদানি করা কাঁচামালের সোর্স কান্ট্রি, দর, মানসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই শেষে দাম নির্ধারণের অনুমতি মিলে। কিন্তু অধিকাংশ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আগেই ওষুধের প্যাকেটে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছাড়ে এবং পরে অনুমোদনের জন্য আবেদন করে।
জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ২২০টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় ওষুধ কারখানার মধ্যে ১৬৪টিতে নিয়মিত ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। এসব কারখানায় প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন হয়। এসব ওষুধ বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ৩৬ হাজার ৬৯৫টি ফার্মেসি রয়েছে। শহরে খুচরা ড্রাগ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৩৩১টি, ডিপোর সংখ্যা ১২৩টি, মডেল ফার্মেসি ২৫টি এবং মডেল মেডিসিন শপ রয়েছে ৩৯১টি।
নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা সাজিদ হাসান ৬ মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখনও চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকের পরামর্শে খাচ্ছেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যথানাশক ট্যাবলেট টোরাক্স ১০। গত আগস্ট মাসে ৫০টি ট্যাবলেটের দাম ছিল ৬শ টাকা, একমাস পর সেই দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার টাকায়। ১২ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতিটি ট্যাবলেট তাকে এখন কিনতে হচ্ছে ২০ টাকায়।
নগরের জামালখান, চমেক হাসপাতাল এলাকা, প্রবর্তক এলাকা সহ অলি-গলির কিছু ফার্মেসিতে খবর নিয়ে জানা গেছে, জ্বর-সর্দি-মাথাব্যথার ওষুধ নাপা ট্যাবলেট একপাতা ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা, নাপা এক্সটেন্ড প্রতি ট্যাবলেট দেড় টাকা থেকে বেড়ে ২ টাকা, ফেক্সো ১৮০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৩০০ থেকে বেড়ে ৩৬০ টাকা, ফ্লুভার ট্যাবলেট প্রতি বক্স ২০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকা, নাপা ও এইচ সিরাপ ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৫ টাকা।
অ্যালার্জির ওষুধ রুপিন ১০ মিলিগ্রাম একপাতা ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা, বিলাস্টিন ২০ মিলিগ্রাম একপাতা ১৬০ থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, অ্যালাট্রল ৫ মিলিগ্রাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা, গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট ফিনিক্স ২০ মিলিগ্রাম প্রতিটি ৭ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা, ফ্যামোট্যাক ২০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট একপাতা ৪৫ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেফাক্লাভ ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতিটির দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে চিকিৎসার ওষুধ জিরোটিল প্লাস ২৫০ মিলিগ্রাম একপাতা ৪৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা, অ্যাজমার ওষুধ ডক্সোমা ২০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট একপাতা ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা, বুটিকট নেবুলাইজার সাসপেনশন বুডেসোনাইড দুই এমএলের দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা, উইন্ডেল প্লাস রেস্পিরেটর সল্যুসন তিন এমএল বোতলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা, চুলকানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত টেট্রাসল ২৫ শতাংশ সল্যুসনের ৩০ এমএল বোতলের দাম ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা হয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীর এমাজিড এম ট্যাবলেট একপাতা ১৫০ থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলিগ্রাম কুইকপেন ৫টির এক প্যাক ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ইনজেকশন হিউমুলিন আর ৩ মিলিগ্রাম কুইকপেনের দাম ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৯০ টাকা।
বক্স হিসেবে হৃদরোগের ভাস্টারেল এমআর ট্যাবলেট ৫৪০ থেকে বেড়ে ৭২০ টাকা, ওএমজি-৩ ক্যাপসুল ২৭০ থেকে বেড়ে ৩৩০ টাকা, রসুভা ৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৫০০ থেকে বেড়ে ৬৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের ন্যাট্রিলিক্স এসআর ১.৫ মিলিগ্রাম ২৭০ থেকে বেড়ে ৩৩০ টাকা, পাইলস রোগীদের ড্যাফলন ১০০০ মিলিগ্রাম ৬৯০ থেকে বেড়ে ৮৪০ টাকা, প্রস্রাবের সংক্রমণ চিকিৎসায় ইউট্রোবিন ৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবক্স মোটিগাট ১০ মিলিগ্রাম ৩৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪২৫ টাকা, ডাইনোজেস্ট ২ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার, ডাইড্রোন ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ২০০ টাকা, ডাইমাইক্রন এম ৩০ মিলিগ্রাম ৩৮০ থেকে বেড়ে ৪২০ টাকা, এমপামেট ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০ টাকা, লিনাগ্লিপ-এম ৫০০ মিলিগ্রাম ৩৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৪২০ টাকা, কমেট ৫০০ মিলিগ্রাম ৪০০ থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা, অ্যানাফ্লেক্স ৫০০ মিলিগ্রাম ৯ টাকা বেড়ে ১৬ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বেড়েছে সব ধরনের ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম ওষুধের দাম। ২০ টাকার ভায়োডিন মাউথওয়াশ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার জেনেরিক নামে অন্তত ২৮০টি ওষুধ বিনামূল্যে রোগীদের সরবরাহ করার দায়িত্ব নিলে ব্যয় হতে পারে পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকা। এটা করা হলে ওষুধ কিনতে গিয়ে রোগীকে যে বিপুল ব্যয় করতে হয়, তা থেকে অন্তত ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বোঝা রোগীর ঘাড় থেকে নেমে যাবে।
পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা জানান, কম-বেশি কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণ অনেক সময় ক্রেতার কাছে ব্যাখ্যা দিতে হয়। দাম নিয়ে তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কও করতে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ওষুধ কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। কিন্তু সেই দাম কতটা যৌক্তিকভাবে বেড়েছে, সেটাই প্রশ্ন। চিকিৎসক যেভাবে প্রেসক্রাইব করবেন সেভাবেই রোগীকে খেতে হবে। তাই জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধকে অত্যাবশ্যক তালিকায় রেখে দামের বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
এসি/টিসি