ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

যেভাবে মামলায় জড়ালেন নিজামী-বাবর

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৪
যেভাবে মামলায় জড়ালেন নিজামী-বাবর মতিউর রহমান নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবর

চট্টগ্রাম: নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার জেটিতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালান খালাস হলেও সেই ঘটনা তদন্তে নির্লিপ্ত ছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। আর অস্ত্রের চালান আটকের সময় ঘটনাস্থল থেকে আসামীকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশের পাশাপাশি তদন্তে প্রভাব সৃষ্টি করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর।



বিগত চারদলীয় জোট সরকারের দু’মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামীদের সাক্ষ্যে। দু’জনকে এসব মামলায় আসামী করার পেছনে তাদের এমন ভূমিকার পাশাপাশি উভয়ই দশ ট্রাক অস্ত্র খালাসের বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন বলে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী।
সাক্ষ্যে মামলার অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.মনিরুজ্জামান।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী ও চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাবর অস্ত্র খালাসের সময় এনএসআই’র কর্মকর্তা লিয়াকতকে ছেড়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘটনা ধামাচাপা দিতে নিজামী যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তাতে এটাই প্রমাণ হয়েছে, তাদের জ্ঞাতসারেই অস্ত্রগুলো এসেছিল এবং সেগুলো খালাস হচ্ছিল।

তিনি বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী জেনেও এটা প্রতিহত করেননি, এটাই অপরাধ। আবার তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেককে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এটা তারা কেন করলেন, রায় দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত নিশ্চয় এসব বিষয় বিবেচনায় নেবেন।

পিপি বলেন, ‘আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষ দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার সঙ্গে নিজামী ও বাবরের সম্পৃক্ততার ঘটনা সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। রায়ে আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলেও আমাদের আশা। ’

অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা মো.মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, অধিকতর তদন্তে যাদের নাম এসেছে তারা শুধু ঘটনা সম্পর্কে জানতেনই না, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দিতে তাদের নাম এসেছে বলেই তাদের সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামী করা হয়েছে।

সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর আদালত সাতটি পর্যবেকক্ষণসহ অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। প্রায় চার বছর ধরে চলা অধিকতর তদন্তের পর মনিরুজ্জামান ২০১১ সালের ২৬ জুন অস্ত্র আটক ও চোরাচালান সংক্রান্ত দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন।

মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় কারাগারে থাকা সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীকে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জড়িত হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয় ২০১১ সালের ৪ মে।

নিজামীকে অভিযুক্ত করার বিষয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী তৎকালীন শিল্পসচিব ড.শোয়েব আহমেদ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রমের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে প্রাপ্ত তথ্যে মতিউর রহমান নিজামীর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে সাবেক শিল্পসচিব শোয়েব আহমদ এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২৫ জানুয়ারি জেরায় তিনি জানান, সিইউএফএল জেটিতে অস্ত্র খালাসের ঘটনা জেনে আমি এ বিষয়ে করণীয় জানতে শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে কথা বলি। মন্ত্রী আমাকে বলেন, বিষয়টি আমি আপনার আগেই শুনেছি, তবে এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। এ বিষয়ে হাইয়েস্ট অথরিটি অবগত আছে।

এরপর আরেকদিন শোয়েব আহমেদ আবারও এ বিষয়ে তদন্তের জন্য নিজামীকে অনুরোধ করলে মন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘আপনি কি মনে করেন আমি হাইয়েস্ট অথরিটির সঙ্গে কথা না বলে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে অবগত আছেন, আমাদের আবার আলাদা করে তদন্ত করতে হবে কেন ?’

একই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ইমামুজ্জামান দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা জানার পর আমি শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলি, যেহেতু ঘটনাটি সিইউএফএল ঘাটে ঘটেছে, তাই এ ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলে ভাল হয়। শিল্পমন্ত্রী আমার এ কথার কোন জবাব দেননি। এতে আমার মনে হল, বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। এসময় তাকে বেশ চিন্তিত ও গম্ভীর মনে হয়েছিল।

সাক্ষ্যে ইমামুজ্জামান বলেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনীহা ও অনাগ্রহের কারণে এবং দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় আমি আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে আর কোন পদক্ষেপ নিতে পারিনি। ’

বিভিন্ন মামলায় আগে থেকে কারাবন্দি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। তাকে দু’দফায় ১০ দিনের রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সম্পূরক অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দশ অস্ত্র খালাসের ঘটনা তদন্তে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির আহ্বায়ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ওমর ফারুক, তিন সদস্য এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহাম্মদ চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি (এসবি) মো.শামসুল ইসলামকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার সঙ্গে লুৎফুজ্জামান বাবরের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এতে আরও উল্লেখ আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ওমর ফারুককে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি মামলার ঘটনা তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দাখিল করেন সেই প্রতিবেদনটিকে তিনি (লুৎফুজ্জামান বাবর) প্রভাবিত করেন যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত প্রতিবেদনে মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ ঘটনার সাথে এনএসআই’র সম্পৃক্ততার বিষয়টি বাদ পড়ে গিয়েছিল।

২০১২ সালের ২৪ মে তদন্ত কমিটির তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক আদালতে সাক্ষ্যে বলেন, প্রতিবেদন তৈরির সময় তদন্তে পাওয়া বিভিন্ন বিষয় যেমন এনএসআই’র গুটিকয় কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর মহোদয়কে অবহিত করি। তদন্ত প্রতিবেদনে এনএসআই’র কতিপয় কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয় অর্ন্তভুক্ত করার প্রয়োজন থাকা স্বত্ত্বেও তা প্রতিমন্ত্রী মহোদয় করতে দেননি। এ বিষয়টি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বাধা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিবেদনে অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য ফররুখ আহমেদ ২০১২ সালের ৩ জুলাই আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে বলেন, তদন্তে জানতে পারি, এনএসআই’র ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান এবং চোরাকারবারী হাফিজুর রহমান অস্ত্র পরিবহনের জন্য ট্রাক ভাড়া করেছিলেন। আমি বিষয়টি শুনে সিআইডি কর্মকর্তাকে (মামলার তদন্তকারী সংস্থা) তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলি। এসময় হাফিজ পলাতক ছিল এবং আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে এনএসআই অফিসে রিকুইজিশন পাঠাতে বলি।

ফররুখ বলেন, আমি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে জানালে তিনি আমাকে বলেন, অনেক কিছুতে জাতীয় স্বার্থ জড়িত থাকে। আপনাদের বুঝেশুনে তদন্তের কাজ করতে হবে।  

তিনি বলেন, ‘কমিটির তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আমরা বললে আমি এনএসআই’র বিষয়টি রিপোর্টে উল্লেখ করার কথা বলি। কমিটির সদস্য পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি শামসুল ইসলামও একই কথা বলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক ও ডিজিএফআই’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করে দেখবে মন্তব্য করে তা রিপোর্টে উল্লেখ করতে বাধা দেন। এরপর তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। ’

প্রসঙ্গক্রমে ফররুখ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র সচিবের অনুমোদনক্রমে এনএসআই’র সম্পৃক্ততার কথা বাদ দিয়ে মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। ’

২০১২ সালের ২২ মে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার এস এম সাব্বির আলী আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে জানান, এনএসআই কর্মকর্তা মেজর লিয়াকত হোসেন সিইউএফএল জেটিঘাটে উপস্থিত থেকে অস্ত্র খালাস কার্যক্রম তদারক করার কথা প্রতিমন্ত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করে এ ব্যাপারে তার করণীয় জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এনএসআই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার না করে অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো নিজেদের হেফাজতে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সাক্ষীদের এসব বক্তব্যের বিষয়ে তাদের বিস্তারিতভাবে জেরাও করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী।

আগামী ৩০ জানুয়ারি দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া দু’টি মামলার রায় ঘোষণার সময় নির্ধারণ করেছেন বিচারিক আদালত চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।