ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

তদন্তে-সাক্ষ্যে এসেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪
তদন্তে-সাক্ষ্যে এসেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা

চট্টগ্রাম: দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্রের চালান দশ ট্রাক অস্ত্র আনা এবং খালাসের ক্ষেত্রে দু’টি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে তদন্ত এবং সাক্ষ্যে উঠে এসেছে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, গোয়েণ্দা সংস্থার রাঘববোয়ালরা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এসব অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা’র হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টায় ছিলেন।

আর সরকারের একাংশ বিশেষত তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাদের সহযোগিতা দিয়েছিলেন।

তবে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা বারবার এসব বক্তব্য নাকচ করে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা সরকারের রোষানলের শিকার বলে আদালতে যুক্তি তুলে ধরেছেন।


গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন, এনএসআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, ডিজিএফআই’র তৎকালীন পরিচালক (সিবিআই) অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (পরে এনএসআই’র ডিজি), এনএসআই’র তৎকালীন পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমাণ্ডার সাহাবুদ্দিন আহাম্মদ, এনএসআই’র সাবেক উপ-পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম লিয়াকত হোসেন এবং এনএসআই’র মাঠ কর্মকর্তা আবর হোসেন খান।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী ও মহানগর পিপি কামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার এসব কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে অস্ত্র খালাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার যোগাযোগ ছিল। এসব অস্ত্র এনে উলফার হাতে দিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সাক্ষ্যপ্রমাণসহ এসব বক্তব্য আদালতের কাছে আমি তুলে ধরেছি। রায়ে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আমি আশা করছি।

মামলার অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের এএসপি মো.মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এসব আসামী উলফাকে শুধু অস্ত্র খালাসে সহযোগিতাই করেনি, নিজেরাই পুরো প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। নিজেদের জবানবন্দি, একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে যা আমি সম্পূরক অভিযোগপত্রে লিপিবদ্ধ করেছি। আবার আদালতে সাক্ষ্যেও বলেছি।

সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর আদালত সাতটি পর্যবেকক্ষণসহ অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। প্রায় চার বছর ধরে চলা অধিকতর তদন্তের পর মনিরুজ্জামান ২০১১ সালের ২৬ জুন অস্ত্র আটক ও চোরাচালান সংক্রান্ত দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন।

অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আকবর হোসেন খান অস্ত্র পরিবহনের জন্য নগরীর দেওয়ানহাটে গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্ট থেকে ট্রাক ভাড়া করেছিলেন বলে সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে।

দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা তদন্তে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সদস্য এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেন। তিনি জানান, ঘটনা তদন্তের সময়ই তারা আকবরের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছিলেন।

একই বছরের ২৩ মে সাবেক সিএমপি কমিশনার এস এম সাব্বির আলী আদালতে সাক্ষ্যে বলেন, মামলার তদন্ত তদারকিতে জানতে পারি, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারূদ পরিবহনের জন্য ট্রাক এবং ট্রলার থেকে মাল নামানো ও ট্রাকে উঠানোর জন্য ক্রেন এনএসআই’র ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন ভাড়া করেন।

এমনকি গ্রীনওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমানও সাক্ষ্যে বলেছেন, তার কাছ থেকে ট্রাক ভাড়া নিয়েছেন আকবর হোসেন খান। এসময় তার সঙ্গে লিয়াকত হোসেনও ছিলেন। তিনি দু’জনকে শনাক্তও করেন।

উলফা নেতা ‘আবুল হোসেন’ পরিচয়ে লিয়াকত হোসেন অস্ত্র খালাসের সময় ঘটনাস্থলে থাকার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশ সার্জেণ্ট হেলাল উদ্দিন ও সার্জেণ্ট আলাউদ্দিন। তারা দু’জনই প্রথম অস্ত্র খালাসের কথা শুনে সিইউএফএল জেটিতে ছুটে যান। একই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার সাব্বির আলীও। সাক্ষ্যে তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে লিয়াকতকে আটক করা হলেও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয়।

সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আকবর জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছেন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ তাকে ট্রাক ভাড়া করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আবার এনএসআই’র ডিজি আব্দুর রহিমও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে সাহাবউদ্দিনের জড়িত থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন এবং তিনি সাহাবউদ্দিনকে ‘ব্ল্যাক শিপ’ বলে উল্লেখ করেন।

সাহাবুদ্দিন আহমেদ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে নিজের দায় স্বীকার করেছেন। জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, এনএসআই ডিজি আব্দুর রহিম তাদের ডেকে অস্ত্র আসার বিষয়টি জানিয়ে খালাসকারীদের সহযোগিতা করতে বলেছিলেন। মূলত সাহাবউদ্দিনের বক্তব্যেই আসামীর তালিকায় নাম উঠে আব্দুর রহিমের।

এরপর ২০১২ সালের ২২মে আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে সাবেক সিএমপি কমিশনার এস এম সাব্বির আলী জানান, ঘটনার দিন রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহ হেল বাকী ঘটনাস্থলে পৌঁছে এনএসআই’র উপ-পরিচালক মেজর লিয়াকত হোসেনকে দেখতে পান। এসময় লিয়াকত হোসেন তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মালামাল খালাস করা হচ্ছে, আপনি কেন আটকাচ্ছেন, বরং খালাসের ব্যাপারে সহযোগিতা করুন। এরপর মেজর লিয়াকত এনএসআই’র ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিমের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ডিসি (পোর্ট) কে এগিয়ে দেন। কিন্তু উনি কথা বলতে অস্বীকার করেন।

এদিকে সাহাবুদ্দিনের জবানবন্দিতে আসামীর তালিকায় নাম উঠে রেজ্জাকুল হায়দারেরও। সম্পূরক অভিযোগপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, সাহাবুদ্দিন জবানবন্দিতে জানান, তিনি অসুস্থ হয়ে ২০০৪ সালের ৩০ মার্চ সিএমএইচে ভর্তি হন। ৩১ মার্চ বিকেলে রেজ্জাকুল হায়দার পরেশ বড়ুয়াকে সঙ্গে নিয়ে সাহাবুদ্দিনকে দেখার জন্য যান। সেখানে রেজ্জাকুল হায়দার তাকে জানান, অস্ত্র আসার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। পরে আবার পরেশ বড়ুয়াকে নিয়ে সিএমএইচ ত্যাগ করেন রেজ্জাকুল।

ডিজিএফআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি ২০১২ সালের ১৫ মার্চ আদালতে সাক্ষ্য দেন। এসময় তিনি জানান, অস্ত্র আটকের পর ডিজিএফআইর’র চট্টগ্রামের ডিটাচমেণ্ট কমাণ্ডার ঘটনার সঙ্গে রেজ্জাকুল হায়দার জড়িত থাকার কথা শুনেছেন বলে জানান। ডিজিএফআই’র ফিল্ড স্টাফদের মাধ্যমে জানতে পারেন, এনএসআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন, উপ-পরিচালক মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআই’র ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন।

এসব গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাইরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব (অতিরিক্ত সচিব) নূরুল আমিন, সিইউএফএল’র তৎকালীন এমডি মোহসীন উদ্দিন তালুকদার এবং জিএম (প্রশাসন) কে এম এনামুল হকও আসামী হিসেবে আছেন।

তাদের বিষয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্রে সিইউএফএল’র তৎকালীন সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা মবিন হোসেন খানের জবানবন্দি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, শিল্প সচিব নূরুল আমিন ঘটনার দিন ট্রেনে করে চট্টগ্রামে আসেন। রাতেই তাকে সিইউএফএল গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে পৌনে ২টার দিকে মবিন হোসেন খান সিইউএফএল জেটিঘাটে অস্ত্র খালাসের তথ্য পেয়ে এমডিকে ফোন দেন। এমডি তাকে বলেন, ঘটনাস্থলে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ ফোর্স আছে। এমডি তাকে সিইউএফএল’র নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বলেন।

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ আছে, মবিন হোসেন খান জবানবন্দিতে বলেছেন, এমডি মোহসীন উদ্দিন তালুকদার এবং জিএম কে এম এনামুল হক কাউকে ঘটনাস্থলে পাঠাননি, নিজেরাও যাননি। এমনকি ঘটনার পরদিনও তারা সেখানে যাননি। তাদের আচরণ ও কার্যকলাপে মনে হয়েছে, তারা উভয়ই ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে জ্ঞাত ছিলেন।

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর আদালতে সাক্ষ্য দিয়েও একই কথা বলেন মবিন হোসেন খান।

২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক শিল্পসচিব ড.শোয়েব আহমেদ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, দেশে থাকা অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত সচিব পরিচয়ে অতিরিক্ত সচিব নূরুল আমিনের সিইউএফএল রেস্ট হাউসে অবস্থান, মন্ত্রণালয়কে কিছু না জানিয়ে কক্সবাজারে যাওয়া সহ নানা বিষয়ে আমার নূরুল আমিনের আচরণ রহস্যজনক মনে হয়েছে। এরপর হঠাৎ করে আমাকে বদলী করে কাদেরী সাহেবকে সচিব করা হল। আবার তাকে বদলী করে নূরুল আমিনকে পূর্ণ সচিব করা হল। এতে আমার ধারণা হয়েছে, শিল্পমন্ত্রী এবং নূরুল আমিন দু’জনই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎপর ছিলেন।

সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত আসামীদের মধ্যে নূরুল আমিন এবং উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া পলাতক আছেন।

আগামী ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া দু’টি মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।