ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জুন ২০২৪, ২০ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

যাদের ত্যাগে স্বাধীনতা

‘বাড়িতে কুলখানির আয়োজন, তখন আমি ফিরলাম’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪
‘বাড়িতে কুলখানির আয়োজন, তখন আমি ফিরলাম’ ছবি: সোহেল সরওয়ার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: পাবনার দূরন্ত কিশোর জলিল। হেসে, খেলে দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর জলিল যান যুদ্ধে।

গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে কিশোর জলিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। সন্তান হারানোর ব্যাথায় শোকাতুর কৃষক বাবা আর আটপৌরে গৃহিণী মা।
বাড়িতে চলছিল কুলখানির আয়োজন। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় লাল-সবুজ পতাকা কাঁধে নিয়ে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরলেন কিশোর যোদ্ধা জলিল। মা-বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।

কিশোর যোদ্ধা জলিল বাড়ি ফিরেছিলেন, কিন্তু জলিলের মত অসংখ্য কিশোর-তরুণ, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ বাড়িতে ফিরতে পারেননি। অসংখ্য বাবা-মায়ের সন্তানের ঠাঁই হয়েছে শহীদের তালিকায়। জলিলের মত দূরন্ত কিশোর কিংবা তরুণ-যুবকদের অসম সাহস আর আত্মত্যাগে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা।

৪৪তম বিজয় দিবসকে সামনে রোববার রাতে নিজ বাসায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেদিনের কিশোর যোদ্ধা জলিল যার পুরো নাম মোহা.আব্দুল জলিল মন্ডল। সেই কিশোর যোদ্ধা এখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার।

‘মা, আমি যুদ্ধে যাব’
১৯৭১ সালে আব্দুল জলিল মন্ডল পাবনার সুজানগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে বাড়ির পাশের নাজিরগঞ্জ হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ১৩ কি ১৪। তার মামা ছিলেন তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিশোর বয়সেই জলিল বুঝতেন রাজনীতি।

মার্চে যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন বাড়িতে ছিলেন জলিল। কিন্তু উঠতি কিশোর হওয়ায় রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হন। পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হত। পদ্মা পাড়ি দিয়ে চরে রাত কাটাতে হত। মাসের পর মাস যায়, অতিষ্ঠ হয়ে উঠে জলিল। তার মত দূরন্ত গ্রামের আরও ৯ কিশোরকে নিজের সঙ্গে জড়ো করলেন।

সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে একদিন মাকে গিয়ে বললেন, ‘মা, আমি যুদ্ধে যাব। ’ জলিলের ভাষায়, ‘শুনে মা-বাবা দুজনই বলল, এখানে থাকলে যখন পাকিস্তানিরা মেরেই ফেলবে, তখন যুদ্ধে চলে যা। একদিন পরই মা-বাবা গিয়ে আমাকে পদ্মায় নৌকায় তুলে দিল। ’

পদ্মা পার হয়ে জলিলসহ ১০ জন রাজবাড়ি পৌঁছালেন। সেখান থেকে কুষ্টিয়া হয়ে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও নৌকায় চড়ে পাঁচদিন পর তারা পৌঁছালেন ভারতে। তবে যশোরের লাঙ্গলবন্দ নদী পার হতে গিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা পাঁচজন রাজাকারের হাতে ধরা পড়ে যান। তাদের বাদ দিয়েই ভারতে পৌঁছান জলিলসহ পাঁচজন।
CMP_Commissioner_1_banglanews24
সম্মুখ যুদ্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন জলিল
ভারতে পৌঁছে প্রথমে তারা নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গায় ইয়ূথ ক্যাম্পে যান। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাড়িতে রিক্রুট ক্যাম্পে নেয়া হয়। কিশোর বয়সী হওয়ায় জলিলকে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে জলিল প্রশিক্ষণ নেয়ার অনুমতি পান। প্রশিক্ষণ হয় শিলিগুড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার নিচে পানিঘাটা মূল ক্যাম্পে। ভারতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে জলিলের সিরিয়াল নম্বর ছিল ৯৬৩৪।

ওই ক্যাম্পে ২১ দিন ধরে প্রশিক্ষণ নেন জলিল। এরপর আবার সাতদিন ধরে রণাঙ্গণে সম্মুখ সমরের কৌশল শেখেন জলিল। কিভাবে গ্রেনেড চার্জ করতে হয়, টু ইনস মর্টার, থ্রি ইনস মর্টার পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন জলিল।

প্রশিক্ষণ শেষে জলিলকে তুফানি ব্যাটেলিয়নের সদস্য করা হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাদের ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুঘাট এলাকায় সীমান্তে যুদ্ধের জন্য নিয়ে আসা হয়। পুরো সীমান্ত জুড়ে জলিলরা বাঙ্কার খনন করে সেখানে বেইজ ক্যাম্প বানিয়ে তারা অবস্থান নেন। রাতের আঁধারে বাঙ্কার তৈরি করতে তাদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন লেগে যায়।

জলিল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাঙ্কারের ভেতরে অবস্থান নিতাম। হিলি বর্ডার থেকে পাকিস্তানি আর্মি শেল ছুঁড়ত বালুঘাট বর্ডারে। বালুঘাটে ইন্ডিয়ার ভেতরে অনেক ঘরবাড়ি ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি আর্মির ঔর্দ্ধত্য যখন সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছাল তখন আমাদের পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতিও চূড়ান্ত হল। বালুঘাট বর্ডারে বাঙ্কারের ভেতর দিয়ে আমরা অবস্থান নিলাম নওগাঁর ফারসিপাড়ায় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছিতে।
CMP_Commissioner_3
নওগাঁর ফারসিপাড়ায় সম্মুখযুদ্ধে জলিল
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নওগাঁর ফারসিপাড়ায় পাকিস্তানি ক্যাম্প ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছেন ভারতীয় মিত্রবাহিনী এবং বাংলার মুক্তিবাহিনী। বাঙালি কমান্ডার বাবুলের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা প্লাটুনে আছেন কিশোর জলিলও। হাতে একটি এসএল আর। বুকের কাছে গামছায় বেঁধে নিলেন কয়েকটা গ্রেনেড।

ফারসিপাড়ার কাছকাছি গিয়ে একটি পুকুর পাড়ে তারা অবস্থান নেন। ডিসেম্বর ৩ অথবা ৪ তারিখ দুপুরে দেখতে পান আগে-পিছে পাক সৈন্যবোঝাই দু’টি ট্রাক এবং মাঝে অফিসার জিপে করে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সেনা সদস্য এমএমজি থেকে জিপ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল। গ্রেনেড ছুঁড়লেন জলিল। পাল্টা জবাব আসল পাক আর্মির কাছ থেকে। ট্রাক ও জিপ গুলির আঘাতে বিকল হয়ে গেল। সন্ধ্যা পর্যন্ত গোলাগুলির পর এক পর্যায়ে পাকিস্তানি আর্মিদের দিক থেকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল।

রাতটা বেইজ ক্যাম্পে কাটিয়ে সকালে ফারসিপাড়া ক্যাম্পে পৌঁছালেন ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। জলিল দেখলেন, গাড়িগুলো বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। ক্যাম্প পুরো খালি। জলিলরা সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুললেন, স্যালুট করলেন। গ্রামের মানুষ জোয়ারের মত এসে সেখানে জড়ো হলেন। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল পুরো এলাকা।

‘যুদ্ধের ময়দানে মোখলেসের জন্য কাঁদতে পারিনি’
নওগাঁর ফারসিপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হন জলিলের সহযোদ্ধা মোখলেস। তার দেহ পুরো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। জলিল তখনও পজিশন নিয়ে আছেন। পাশেই সহযোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহ। জলিল পাশে ফিরে তাকিয়ে লাশ দেখে মাথার টুপি খুলে নেন। ক্ষীণ কণ্ঠে জয় বাংলা শ্লোগান দেন। এসময় কিছুটা বেদনাকাতর হলেও ভাবনার ফুরসত ছিলনা জলিলের।

জলিল মন্ডলের ভাষায়, গুলিটা আমার বুকেও লাগতে পারত। আমিও মরতে পারতাম। কিন্তু মোখলেস মরেছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে আমি মোখলেসের জন্য বিলাপ করতে পারিনি। যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে হয়।
CMP_Commissioner_2
‘তোমারা দেশ আজাদ হো গেয়া’
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে জলিলসহ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বালুঘাটে বেইজ ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন এসে তাদের বললেন, ‘তোমারা দেশ আজাদ হো গেয়া’। সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙ্গা  উল্লাস, জয়ধ্বনি। জয় বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত পুরো ক্যাম্প। এসএলআর’র মাথায় গলার গামছা বেঁধে পতাকার মত করে উড়াতে লাগলেন জলিল।

১৭ ডিসেম্বর বেইজ ক্যাম্প থেকে বগুড়ায় এসে পুলিশ লাইনের বিপরীতে শাহ সুলতান ক্যাম্পে তারা অবস্থান নিলেন। সেখানে ২০ দিনেরও বেশি অবস্থান করেন তারা। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার তথ্য পান রেডিওতে। তখন আর মন মানছিলনা জলিলদের। বগুড়ায় অস্ত্র জমা দিয়ে ১০ জানুয়ারি রাতেই ট্রেনে উঠলেন। ঈশ্বরদী পর্যন্ত ট্রেনে পৌঁছে সেখান থেকে যান পাবনায়।

‘বাড়িতে কুলখানির আয়োজন, তখন আমি ফিরলাম’
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন জলিল। দেখলেন তার বাবা গরুর জন্য কাটা ঘাস এনে রাখছেন বাড়ির উঠোনে। বাবা ছেলেকে দেখে প্রথমে চিনতে পারলেন না। চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে এলেন মাও।

জলিল বাংলানিউজকে বলেন, ‘গ্রামে খবর রটেছে আমাকে মাথায় গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানিরা। আমি শহীদ হয়েছি। আমার কৃষক বাবা আমার নামে মিলাদ দিয়েছে, বাতসা বিতরণ করেছে। বাড়িতে কুলখানিরও আয়োজন চলছিল, কিন্তু তখন আমি ফিরে এলাম। ’

সেদিনের বাড়ি ফেরার স্মৃতিচারন করে প্রয়াত মা-বাবার জন্য, রণাঙ্গণে হারানো শহীদ সহযোদ্ধাদের জন্য আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন জলিল মন্ডল। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছিল পানি। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘অনেক মা-বাবার চোখের পানিতে, লাখো শহীদের রক্তে স্নাত এই বাংলাদেশ। এই দেশ এগিয়ে যাবেই, অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ’

** নতুন প্রজন্ম সফলভাবে এগিয়ে যাবে

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘন্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।