ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বিজ্ঞানী হওয়ার গল্পে মায়ের জন্য কাঁদলেন ড. সেঁজুতি 

মোহাম্মদ আজহার, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫১ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২২
বিজ্ঞানী হওয়ার গল্পে মায়ের জন্য কাঁদলেন ড. সেঁজুতি  'ড. সেঁজুতি সাহার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প' অনুষ্ঠান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: আমি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আমার মা সবকিছু ছেড়ে কানাডায় চলে আসেন। এরপর আমার দীর্ঘ ১ বছর আমার চিকিৎসা চলে।

মা আমার পাশেই ছিলেন। এমন শক্তিশালী একজন মা, যাকে কখনো আমাদের সামনে কাঁদতে দেখিনি।
অথচ সেই মাকে তখন প্রায় দেখতাম, আমার পাশে বসে বসে কাঁদছেন। কারণ তখন আমার মায়ের কন্ট্রোলে কিছুই ছিলো না। মায়েরা বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন সন্তানদের।

কথাগুলো বলেই কেঁদে ওঠেন বাংলাদেশি অনুজীব বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা। দৃষ্টি চট্টগ্রাম'র আয়োজনে রোববার (২২ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে 'ড. সেঁজুতি সাহার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প' অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণকালে এসব কথা বলেন তিনি।

ড. সেঁজুতি সাহা একজন বাংলাদেশি অণুজীববিজ্ঞানী। আণবিক জিনতত্ত্বের এ গবেষক বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য গবেষণায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) কাজ করছেন। সেঁজুতি সাহা ও সিএইচআরএফ প্রথম বাংলাদেশের রোগীদের মধ্য থেকে পাওয়া নমুনা থেকে নতুন করোনা ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস উন্মোচন করেন। বাংলাদেশ থেকে ও লেভেল শেষ করে ২০০৫ সালে কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। জৈব রসায়নে স্নাতক শেষ করে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক জিনতত্ত্বে পিএইচডি করেন।

২০১৮ সালে তিনি বিল গেটসের 'বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেন। ২০২০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল পোলিও ইরেডিকেশন ইনিশিয়েটিভের বোর্ড মেম্বার নিযুক্ত হন তিনি। তার বাবা বাংলাদেশের আরেক প্রসিদ্ধ অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা ও মা ড. সেতারুন্নাহার গণস্বাস্থ্যের গবেষক।  

রোববার (২২ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে ড. সেঁজুতি সাহা'র বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প শুনতে আসেন শতশত শিক্ষার্থী। সঞ্চালক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প।

ড. সেঁজুতি বলেন, আমি ছোটবেলায় গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলাম। মাসুদ রানার তিন গোয়েন্দা পড়ে আমার গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সবসময় বাবা মায়ের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কাজগুলো দেখে একসময় বিজ্ঞানী হওয়ারও স্বপ্ন তৈরি হয়। তবে ক্রাইম বের করার খুব আগ্রহ ছিল তিন গোয়েন্দা বই পড়ে। আমি যখন অণুজীব নিয়ে কাজ করি, তখনও ব্যাকটেরিয়াগুলোকে আমি ক্রাইম মনে করি। তাই এখানেও নিজেকে গোয়েন্দাই মনে হয় আমার।

বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিলে আমাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে। আমি ইন্টার পর্যন্ত বাংলাদেশেই পড়েছি। এরপর আমার খুব কাছের বান্ধবী নাবিলা কানাডায় ভর্তি হয়েছিল। তাই আমি বাবার ক্রেডিট কার্ড চুরি করে ঐ টাকা দিয়ে কানাডায় ভর্তির আবেদন করি। আসলে উন্নত দেশগুলোর একাডেমিক প্রোগ্রামগুলো খুব ভালো। পরিবারের সাপোর্ট থাকলে বাইরের দেশে পড়াশোনা করতে যাওয়াটাও একটা ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এরপর আবার দেশে ফিরে আসা উচিত, দেশের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। কারণ শেকড় ভুলে যাওয়া যাবে না। আমার বাবা-মা একই কাজ করেছেন। যেদিন থিসিস জমা দিয়েছিলেন, এর পরদিন দেশে ফিরে এসেছিলেন। বাবা-মা সবসময় আমাদের মনে করিয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাস, যার ফলে আমাদের দেশপ্রেম তৈরি হয়েছিল। আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পাই আমার বাবা-মাকে দেখে।  

যখন কোভিডের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করি, তখন হঠাৎ সারাদেশে সাড়া পড়ে যায়। আমি তখন অনেকের কাছ থেকে ম্যাসেজ পেতে থাকি। সেখানে অনেক মেয়ে আবার অনেক মায়েরাও তাদের সন্তানদের বিজ্ঞানী বানাতে চায়, এমন ম্যাসেজ পেতে থাকি। আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমার এখন দেশের প্রতি অনেক দায়িত্ব। এরপর আমি ঢাকার বাইরে যেতে শুরু করি। সবার কথা শোনার চেষ্টা করি।

বাংলাদেশি হওয়ায় আমাদের কাজের মূল্যায়ন সেভাবে হয় না। এমন একটি ঘটনা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছিল। তবে আমাদের কাজ বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা না। আমরা শুধু মানুষের কী উপকার হচ্ছে সেটাই দেখবো। অনেক বেশি গবেষণা করতে হবে আমাদের। আমরা যত বেশি কাজ করবো, ততই সারাবিশ্বে আমাদের অবস্থান তৈরি হবে।

ইপসার সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন বলেন, ড. সেঁজুতি সাহার গল্প যখন আমার ছোট মেয়েটাকে বললাম, তখন দেখলাম আমার মেয়েরও ইচ্ছে সে-ও একজন বিজ্ঞানী হবে। এরকম একজন আলোকিত মানুষ আমাদের মাঝে এসে সৌরভ ছড়ানোর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।  

সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। আড্ডায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।  

অনুষ্ঠানের শুরুতে আবৃত্তি করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক মিলি চৌধুরী। এ সময় চবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. অলক পাল, দৃষ্টি চট্টগ্রামের উপদেষ্টা সাফিয়া গাজী রহমান, দৃষ্টির সভাপতি মাসুদ বকুল, সাধারণ সম্পাদক সাবির শাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আরাফাত ও দৃষ্টি চট্টগ্রামের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২২
এমএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।