ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

নবপত্রিকা স্নান দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
নবপত্রিকা স্নান দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা

কলকাতা: ষষ্ঠীর বোধনের পর মহাসপ্তমীর সকাল থেকে শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান রীতি, নবপত্রিকা স্নান (গোসল)।

চলতি কথায় কলাবউ স্নান, যা দেখতে কলকাতার গঙ্গাঘাটে ভিড় করে শহরবাসী। সনাতন সম্প্রদায়ের কাছে দিনটি অতি পবিত্র।  

দুর্গা পূজার রীতি অনুযায়ী, চলতি বছর শনিবার (২১ অক্টোবর) সপ্তমী। গঙ্গাঘাটে রীতি শেষ হলে মণ্ডপে বা বাড়িতে কলাবউকে কেউ নিয়ে যান কাঁধে করে, কেউ পালকি করে। সপ্তমীর সকালে নয়টি গাছের সমন্বয়ে কলাবউ এসে বসে গণেশের পাশে। তাই অনেকেরই ধারণা কলাবউ গণেশের স্ত্রী। তবে তা ভুল ধারণা। নবপত্রিকা আসলে দুর্গারই রূপ। রীতি অনুযায়ী, এই গাছ আদৌ গণেশের স্ত্রী নন, বরং মা দুর্গা অর্থাৎ গণেশের জননী।

নবপত্রিকা বলতে বোঝানো হয় নয়টি গাছকে। দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই নয় দেবী হলেন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকা বাসিনী নবদুর্গা’ নামে পূজিতা হন।

যাতে মূলত দৃশ্যমান কলাগাছ। এটি ছাড়াও আটটি গাছ থাকে। যা বাঁধন দেওয়া হয় শ্বেত অপরাজিতার লতা ও হলুদ সুতা দিয়ে। এই নবপত্রিকায় থাকে কলা গাছ, কচু গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তী গাছ, বেল গাছ, ডালিম গাছ, অশোকের ডাল, মান কচু গাছ এবং ধান গাছ।

মহাসপ্তমীর দিন সকালে কাছের কোনো নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত বা পরিবারের জ্যেষ্ঠ কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান নদীতে। তার পেছনে থাকে ঢাক বাদকের দল। নারীদের হাতে থাকে শঙ্খ এবং উলুধ্বনি। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী, মন্ত্রোচ্চারণ করে নবপত্রিকা নিয়ে ব্যক্তিটি জলাশয়ে ডুব দেন।  

এরপর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তাতে দেওয়া হয় সিঁদুরের টিপ। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দুর্গা প্রতিমার ডান দিকে অর্থাৎ গণেশের পরই একটি কাঠের সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজো মণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানিকতার সূচনা হয়। এমনকি, পূজার বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা, দুর্গা ও বাকী প্রতিমার সঙ্গে পূজিত হতে থাকে।

গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজো প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা করা। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত তার বইতে লিখেছেন, এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক রূপে গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজার মূলে বোধহয় এই শস্য দেবীরই পূজা। ‘দুর্গায়ৈ সপরিবারায়ৈ’ গ্রন্থে লেখক গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর অভিমত, দুর্গাপূজার সপ্তমী সকালবেলায় উঠেই প্রথম এবং প্রধান কাজটি হল নবপত্রিকার প্রতিষ্ঠা, যাকে লৌকিক ভাষায় বলে কলাবউ স্নান।

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, নবপত্রিকা বলতে অর্থাৎ নয়টি পাতা মানে আসলে নয়টি গাছ, নয়টি উদ্ভিদ। বাংলার মানুষদের অতিসাধারণ খাদ্য। নবপত্রিকার প্রধান গাছ হল কলাগাছ, যা ‘ফার্টিলিটি’র প্রতীক। আবার কচু আশ্বিনের প্রথমে হয়। বাঙালির পেট ভরায়। আবার একই ধরনের আর এক আনাজ মানকচু। শরতের রোদ্দুর পেলে এটাও খুব সুস্বাদু হয়। ফলের মধ্য আছে বেল ও দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম। বেলপাতা শিব এবং পার্বতীর প্রিয় এবং ওষুধি গুণও আছে। ডালিম আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত ভালো ফলে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে বা শরীর দুর্বল হলে ডালিম দারুণ কাজ করে।

এছাড়া আছে জয়ন্তী এবং অশোক গাছ। এই দুটি আয়ুর্বেদের মহৌষধের কাজ করে। আবার জয়ন্তী দুর্গার একটি নাম। এর বীজ স্ত্রীরোগ নিরাময়ের কাজে লাগে। এরও ফলনও হয় আশ্বিনের শেষে। এছাড়া আছে হলুদ। কাঁচা হলুদ থেকে পাকা হলুদ শরীরের পক্ষে যেমন ভাল, তেমন বহু পূজা উপাচারে ব্যবহৃত হয়। এর থেকেই বোঝা যায় এই সময়ে ফুলফলে ভরে এমন ফলদায়িনী বৃক্ষের পাতার সমন্বয় হল নবপত্রিকা। আদতে শস্যের দেবী এবং মানুষের উপকারী গাছ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
ভিএস/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।