ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

একাত্তরের স্মৃতিচারণে আকাশবাণী কর্মকর্তা

‘শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, বড়ো কিছু ঘটতে চলছে’

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
‘শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, বড়ো কিছু ঘটতে চলছে’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। আর সেটা যদি হয় একটা জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ, তবে তো মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায় পরিস্থিতি।

কখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, কখনও বা অতি সাবধানে মুক্তিকামীদের গোপন আস্তানায় গিয়ে বা তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করতে হয় খবর। অনেক সময় ঘটনার আগের মুহূর্তেও জানা যায় না, পরের মুহূর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে।  

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। সময়টা এপ্রিল মাস। কলকাতায় তখন খুব গরম পরেছে। মাঝে মধ্যে কালবৈশাখী হানা দিচ্ছে। অফিস থেকে রাতে কাজ শেষ করে ফিরবো বলে তৈরি হচ্ছিলাম, এমন সময় জানতে পারলাম, সেদিন রাতে আর বাড়ি ফেরা হবে না। রাতে কোন এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহে আমাদের যেতে হবে...।

কিন্তু কোথায় যেতে হবে? শুধু বলা হলো, রাত ৩টার দিকে হাজির হতে হবে কলকাতা প্রেসক্লাবে। এর বেশি কিছুই জানানো হলো না। যারা কলকাতা প্রেসক্লাব চেনেন না, তাদের জানার জন্য বলে রাখি, কলকাতা ময়দানের একটি অংশে কলকাতা প্রেসক্লাব। কিন্তু রাত ৩টার সময় প্রেসক্লাবে কী হবে?

তখন কলকাতায় নকশাল আন্দোলন চলছে। রাত ৩টার সময় দুই সঙ্গীকে নিয়ে কলকাতা প্রেসক্লাবে হাজির হয়ে দেখা গেলো ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত আরও অনেক সাংবাদিক। কিন্তু কেউ জানেন না, কী সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাদের ডাকা হয়েছে। সেখানেই দেখা পাওয়া গেলো বিএসএফ’র তৎকালীন জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা সমর বসুর।

আমাদের (সাংবাদিকদের) কোথায় নিয়ে যাবেন- এ প্রশ্নে তিনি হেসে বললেন, ‘চলোই না’। এর বেশি কিছু জানানো হলো না।

সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। সবাই বুঝতে পারছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। গাড়িতে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে জানিয়ে দেওয়া হলো, বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আমরা সেখানে যাচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছুই জানানো হলো না।

আমার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সহকর্মী প্রনবেশ সেন। গাড়ির ড্রাইভার ভবতোশ দাসকে বলা হলো, সামনের গাড়িগুলোকে অনুসরণ করতে।

ধীরে ধীরে ভোর হয়ে এলো। আমারা তখন কৃষ্ণনগর পৌঁছেছি। আরও কিছুটা পথ চলার পর একটা জায়গায় সবকটা গাড়ি থামানো হলো। বলা হলো, এবার পায়ে হেঁটে যেতে হবে। রাস্তা একদম ফাঁকা। বেশ কিছুটা পথ চলার পর দুয়েকজন মানুষের দেখা পাওয়া গেলো। চারদিক আমগাছে ঘেরা একটা জায়গায় থামতে বলা হলো আমাদের। দেখলাম, বেশ কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে লাইট মেশিনগান। তখনও জানি না, কী ঘটতে চলেছে সেখানে। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম। একটা চাপা উত্তেজনা।

কিছুটা দূরে একটা মঞ্চের সামনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। ছোট্ট মঞ্চ। রঙিন কাগজ আঠা দিয়ে সেঁটে মঞ্চ বানান হয়েছে। জানানো হলো, আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে। এখানকার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘মুজিবনগর’। মঞ্চে শুরু হলো সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’। একে একে মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে (২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এর আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। ) স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা। জানানো হলো, শপথ গ্রহণ হবে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার।

ফেরার পথে ভাবছিলেম, একদিন পলাশীর আম্রকাননে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। সেই আম্রকাননের দক্ষিণে বাংলাদেশের মাটিতে আরেক আম্রকাননে শপথ নিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা।

বাংলানিউজকে এভাবেই স্মৃতি রোমন্থন করে ইতিহাসের সেইসব রোমাঞ্চকর দিনের কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’প্রাপ্ত আকাশবাণী কলকাতার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপেন তরফদার।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
ভিএস/আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।