ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

এজেন্ট ব্যাংকিং

সংগৃহীত আমানত পল্লিতে বিতরণ বৃদ্ধির সুপারিশ

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
সংগৃহীত আমানত পল্লিতে বিতরণ বৃদ্ধির সুপারিশ

ঢাকা: এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পল্লি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত আমানত বিতরণ করা হচ্ছে শহরে। এজেন্ট ব্যাংকিয়ে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় পল্লি অঞ্চলে বিতরণ করা যাচ্ছে না।

এ আমানত পল্লি অঞ্চলে বিতরণ করা গেলে ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে, কর্মসংস্থান হবে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এজেন্ট ব্যাংকিং সরাসরি অবদান রাখতে পারবে। এমন ধারণা করছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।

প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি এ সম্পর্কিত একটি জরিপ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী সংস্থার (এনজিও) নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকেও (এমআরএ) পাঠিয়েছে।

সুপারিশে বলা হয়, শাখা না খুলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহার করে কম সময়ে পল্লি অঞ্চল ও শহরের দরিদ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহে বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ, যারা ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের বাইরে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠী। এসব মানুষ শরাঞ্চলের মতো নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত- গ্রামাঞ্চল, হাওর, বিল, চরাঞ্চল উপকূল ও পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। তারা সবাই নিম্ন ও নিম্ম-মধ্যবিত্ত মানুষ।

এসব মানুষ আমানত হিসাবে টাকা রাখতে পারলেও ঋণ হিসাবে পাচ্ছে না। জরিপে উঠে আসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে ঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে না। আমানত চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকের তহবিলে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়, আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে ৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। একই সময়ে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৩০৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, যা মোট আমানতের ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ আরও কম। অর্ধাৎ পল্লি অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বাকি ৯৬ শতাংশ চলে গেছে শহরের শিল্প, ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের ভোক্তা ঋণে।

পরবর্তী তিন বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পল্লি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত আমানত শহরে পাঠানোর হার আরও বেড়েছে। আর কমেছে পল্লিতে ঋণ বিতরণের হার।

এজেন্টি ব্যাংকিং নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত আমানত সংগ্রহ ও বিতরণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, আমানত সংগ্রহের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমেছে পল্লি অঞ্চলে বিতরণের হার।

২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে মোট আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে পল্লি অঞ্চল থেকে আমানত করা হয়েছে ২৩ হাজার ৭৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট আমানতের ৮০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর শহরাঞ্চল থেকে আমানত সংগ্রহ করে ৫ হাজার ৯১১ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা মোট আমানতের ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

এ সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৭৮৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা মোট সংগৃহীত আমানতের ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর পল্লি অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ২ লাখ টাকা, যা সংগৃহীত আমানতের ২ দশমিক ১৮ শতাংশ।

তথ্য বলছে, এজেন্ট ব্যাংকিং যত বাড়ছে পল্লি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত আমানত তত বেশি বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে কমছে পল্লি অঞ্চলে ঋণ বিতরণের হার। পিকেএসএফ বলছে, যেহেতু এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা কম জনবল নির্ভর, সেহেতু এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা যেতে পারে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এমআরএ এ সম্পর্কিত নীতিমালা করতে পারে।

ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ বিতরণ করলে তা সফলভাবে বিতরণ সম্ভব। এ ঋণ যেমন কাজে লাগে, আবার ফেরতও আসে। পূবালী ব্যাংকের অর্থ ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ কার্যক্রমের চিত্র তুলে ধরা হয়।

সুপারিশে তুলে ধরা হয় ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কার্যক্রম, সক্ষমতা ও সফলতা। ডিসেম্বর ২০১৮ নাগাদ ক্ষুদ্র অর্থায়ন সংস্থা প্রায় ৩ কোটি ৯৫ লাখ সদস্যকে আর্থিক সেবা দিয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার দক্ষ জনবলের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো গ্রামাঞ্চলে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এবং ৪৯ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয় হিসাবে সংগ্রহ করেছে। যার অধিকাংশ পুনরায় গ্রামাঞ্চলে ঋণ হিসাবে বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে এজেন্ট ব্যাংকিং দ্বারা সংগৃহীত আমানত গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

পল্লি অঞ্চল থেকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের বড় অংশ পল্লিতেই বিতরণ বৃদ্ধির পক্ষে মত দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যিনি এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছিলেন সেই সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তবে তিনি মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসকেও (এমএফএস) যুক্ত করার পরামর্শ দেন।

বাংলানিউজকে আতিউর রহমান বলেন, এটা সম্ভব হলে ক্যাশলেস সোসাইটির লক্ষ্যে যে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার, তা ত্বরান্বিত হবে। মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসসহ সকল আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনের জন্য ‘বিনিময়’ নামের যে কমন প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটারও ব্যবহার জোরদার করতে হবে। তাহলেই ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার বিপুল অগ্রগতি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। পুরো সমাজকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনুষ্ঠানিক ভাবে যুক্ত করা যাবে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায়।

কৃষিঋণ, এমএসএমই-সহ বিভিন্ন রকম ছোট ও মাঝারি ধরনের ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে পল্লিতে অর্থ পাঠানোর জন্য কার্যক্রম চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব ঋণের লক্ষ্য প্রায়ই পূরণ করা সম্ভব হয় না। প্রণোদনা কর্মসূচির পুরো অর্থ গ্রামে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। তাই নতুন করে কম সুদের বিশেষ কৃষি ও এমএসএমই ঋণের প্রচলন করেছে। এসব ঋণের সফল বাস্তবায়নে দরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও বেশি মনোযোগী ও গ্রামমুখী হওয়ার।

এজেন্ট ব্যাংকিং বিষয়ে পিকেএসএফ-এর দেওয়া সুপারিশ সমার্থন করেন এই সাবেক গভর্নর। তিনি পল্লী ঋণ বা কৃষি ঋণ বিতরণে লক্ষ্যপূরণে সকল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের অন্তত ২ শতাংশ পল্লি বা কৃষি ঋণ হিসাবে বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এ ঋণ। ঋণ বিতরণের পর ফেরতেরও হারও সন্তোষজনক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি পল্লি ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ঋণ কর্মসূচিও চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, এ ঋণের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বিতরণ করা হয় ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে। যাদের যথেষ্ট গ্রামীণ শাখা নেই, সেসব ব্যাংক এই অংশিদারত্ব ব্যবস্থার সুফল পাচ্ছে।

ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী (এনজিও) সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ব্যাংকের অর্থ বিতরণ করছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোগুলোতে কৃষিঋণ, এমএসএমই, নারী উদ্যোক্তা ঋণসহ বিভিন্ন রকম পল্লি ঋণ কার্যক্রম চালু আছে। এসব ঋণ কার্যক্রম জোরদার ও টেকসই করার পক্ষে মতো দেন গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ব্যাংকের অনেকগুলো সেবা আছে। এর মধ্যে আমানত রাখা, আমানত তোলা, বিভিন্ন রকম বিল পরিশোধ করা, টাকা স্থানান্তর করা, প্রবাসী আয় দেশে স্বজনদের কাছে পৌঁছানো, বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি। এসব কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজই হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। এগুলো সুষ্ঠভাবেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমানত সংগ্রহ অনেকগুলোর একটি।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানুষ সঞ্চয়ে উৎসাহী হচ্ছে, ব্যাংকিংয়ে উৎসাহী হচ্ছে, ঘরে বসে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রবাসী আয় পাচ্ছে। সুতরাং এজেন্ট ব্যাংকিং কাজ করছে। এটা থেকে বাড়িয়ে ঋণ দেওয়া হবে কিনা, সেটা পরের প্রশ্ন। ইতোমধ্যে কিছু ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কিছু কিছু ঋণ বিতরণ করছে। একেবারে যে হচ্ছে না তা নয়, সীমিত আকারে হচ্ছে। কারণ এজেন্টের ওপরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ জন্য সীমিত আকারে বিতরণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
জেডএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।