ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

স্বর্ণের অলংকার বিক্রির কি এখনই সময়

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩
স্বর্ণের অলংকার বিক্রির কি এখনই সময়

দিন দিন বাড়ছে স্বর্ণের দাম। চলতি বছরের প্রথম দুই সপ্তাহেই ভরিতে ৫ হাজার টাকা দাম বেড়েছে।

আর সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাড়লেই দাম হবে লাখ টাকা। এদিকে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন যারা অলংকার তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন। অন্যদিকে জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরাও দেখা পাচ্ছেন না ক্রেতাদের।

তবে যাদের কাছে পুরোনো অলংকার রয়েছে, তারা আছেন খুশি মেজাজে। হিসাব করছেন, বিক্রি করে দিলে দাম কেমন মিলবে। আবার অনেকে আশায় আছে দাম আরও বাড়ার। তবে আগামী দিনগুলোতে স্বর্ণের দাম বাড়বে কিনা, সেটি এখনই নিশ্চিত নয়।

স্বর্ণের দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে স্বর্ণের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা এখন পর্যন্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

তারপরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে উত্থান-পতনের মধ্যেই ছিল স্বর্ণের দাম। গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্ব অর্থনীতি নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হতে থাকে। তখন স্বর্ণের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গত বছরের ৮ মার্চ বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। তারপর অবশ্য কমতে থাকে। অক্টোবরে ১ হাজার ৬৫০ ডলারে নামে। বছরের শেষ দিকে আবার দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার এই দাম ১ হাজার ৯২০ ডলারে পৌঁছেছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় মানুষ স্বর্ণয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। তখন স্বর্ণ থেকে অর্থ তুলে বন্ডে বিনিয়োগ সরিয়ে নেন বিনিয়োগকারীরা। এখন ঘটছে ঠিক তার উল্টো। টানা কয়েক মাস নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি কমার ইঙ্গিত মিলছে। তাতে সামনের দিনে নীতি সুদহার বাড়লেও আগের মতো গতি আর না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সে জন্য বিনিয়োগকারীরা বন্ড থেকে স্বর্ণয় ফিরছেন। তার ফলে স্বর্ণের চাহিদা ও দাম—দুটোই বাড়ছে।

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে দেশেও দাম বাড়ে। আর দাম বাড়ানোর সেই কাজটি করে থাকে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস। গত ডিসেম্বরের শুরুতে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের ১ ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ছিল ৮৪ হাজার ২১৪ টাকা। তারপর চার দফায় ভরিতে বেড়েছে ৯ হাজার ২১৫ টাকা। গতকাল রোববার প্রতি ভরি স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা ভরি। এটিই দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম।

বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও স্বর্ণের দামে রেকর্ড হয়েছে। গত শুক্রবার দেশটিতে ১০ গ্রাম পাকা স্বর্ণের (২৪ ক্যারেট) দাম ৫৬ হাজার ২৪৫ রুপিতে ওঠে। আর ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৭২০ রুপি। তার মানে ১ ভরির (১ ভরিতে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) দাম দাঁড়াবে ৬০ হাজার ৩২৬ রুপি।    

স্বর্ণের দামের পাশাপাশি চাহিদা-জোগানের বিষয়ে কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক। স্বর্ণের চাহিদা মূলত দুভাবে তৈরি হয়। যেমন গয়নার চাহিদা ও স্বর্ণয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়না হিসেবে স্বর্ণের বেশি ব্যবহার হয় চীন ও ভারতে। পশ্চিমা দেশগুলোতেও গয়নার ভালো চাহিদা আছে। চাহিদার মতো সরবরাহ নিশ্চিত হয় দুইভাবে—খনি থেকে নতুন উত্তোলন এবং পুরোনো স্বর্ণ বিক্রি। যদিও স্বর্ণখনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, গত ২০২১ সালে খনি থেকে ৩ হাজার ৫৭০ টন স্বর্ণ উত্তোলন হয়। আর পুরোনো স্বর্ণ থেকে পাওয়া যায় ১ হাজার ১৩৬ টন। অন্যদিকে গয়না তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ২ হাজার ১৫২ টন স্বর্ণ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ২৭৪ টন। আর বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬০৫ টন স্বর্ণের বার ও মুদ্রায় বিনিয়োগ করেছে।

বিশ্বজুড়ে টন টন স্বর্ণের চাহিদা ও জোগানের ভিড়ে বাংলাদেশের বাজার কিন্তু খুবই ছোট। সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও দেশে বছরে প্রায় ২০-৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। তার মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পুরোনো অলংকার দিয়ে মেটানো হয়। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও বিপুল স্বর্ণ আসে। তাই স্বর্ণের বাজার ও জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরুতে কিছু আমদানি হলেও পরে তা শ্লথ হয়ে যায়।

এবার আসল কথায় আসা যাক। পুরোনো অলংকার বিক্রি করলে মুনাফা কত? বাংলাদেশ যে বছর স্বাধীন হয়, তার আগের বছর স্বর্ণের ভরি ছিল ১৫৪ টাকা। বর্তমানে দাম ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। তার মানে গত পাঁচ দশকে দাম বেড়েছে ৬০৬ গুণ। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার সিন্দুকে থাকা পুরোনো অলংকারের দামও বেড়েছে।

সাধারণত পুরোনো অলংকার জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গেলে তারা ওজন করার পর তা কোন ক্যারেটের স্বর্ণ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। গত আগস্টে জুয়েলার্স সমিতি ১৫ শতাংশ বাদ দেওয়ার নিয়ম করলেও পরে তা বাদ দেয়। সেই নিয়ম থাকলে মুনাফা আরও বেশি মিলত।

ধরা যাক, ২০১৫ সালে ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার কিনেছিলেন। তখন স্বর্ণের ভরি ছিল ৪৩ হাজার ১৪ টাকা। এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি ৭৪ হাজার ৭৪৩ টাকা পাবেন। তাতে ভরিতে আপনার মুনাফা হবে ৩১ হাজার ৭২৯ টাকা। আবার যদি স্বর্ণের অলংকার আরও আগে কেনা হয় তাহলে মুনাফা আরও বেশি পাবেন। ধরুন, ২০০৫ সালে ১৩ হাজার ৮৩৩ টাকা ভরিতে কেনা ২২ ক্যারেটের এক ভরির স্বর্ণের অলংকার আপনার ঘরে রয়েছে। সেটি বিক্রি করলে বর্তমানে মুনাফা পাবেন ৬০ হাজার ৯১০ টাকা। ২১ ও ১৮ ক্যারেটের অলংকার হলে মুনাফা ভিন্ন হবে।

অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, অলংকারটি যে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা, সেখানেই নিয়ে যান। সঙ্গে অবশ্যই রসিদটি নিতে ভুলবেন না। অন্য কোনো জুয়েলার্সে অলংকার বিক্রি করতে গেলে মুনাফা কিছুটা কমে যাবে। কারণ, তখন তারা অলংকারের বর্তমান ওজন থেকে ২২-২৪ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করবে।

এক যুগ আগেও দেশের জুয়েলারি ব্যবসায় বিশৃঙ্খলা ছিল। স্বর্ণের অলংকার ভাঙালে শেষ পর্যন্ত কতটুকু বিশুদ্ধ স্বর্ণ পাওয়া যাবে, তা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সংশয় ছিল। তবে ২০০৭ সালে হলমার্ক বাধ্যতামূলক করে জুয়েলার্স সমিতি। এতে যেটি হয়েছে, অলংকারের গায়ে কতটুকু বিশুদ্ধ স্বর্ণ আছে, তা খোদাই করে লিখে দেয় বিক্রেতা। সেই সঙ্গে অলংকার কেনার রসিদে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হয়। সাধারণত অলংকার প্রস্তুত করার পর নির্দিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তা পরীক্ষা করে বিশুদ্ধ স্বর্ণের পরিমাণটি বের করা হয়। যদিও ব্র্যান্ডের জুয়েলার্সগুলো সেটি মেনে চললেও মফস্‌সলের ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠান হলমার্কের বিষয়টি পরিপালন করে না।

কয়েকজন জুয়েলার্স ব্যবসায়ী জানান, দেশে বর্তমানে ২২, ২১ ও ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণের অলংকার বেশি তৈরি হয়। সনাতন পদ্ধতির অলংকার সেই অর্থে তৈরি হয় না। ২২ ক্যারেটের এক ভরি অলংকারে ১৪ আনা ২ রতি বিশুদ্ধ স্বর্ণ থাকে। ২১ ক্যারেটে ১৪ আনা ও ১৮ ক্যারেটে ১২ আনা বিশুদ্ধ স্বর্ণ থাকে। সনাতন পদ্ধতির অলংকারে বিশুদ্ধ স্বর্ণের পরিমাণ বড়জোর ১০ আনা। আর জানেন তো, ১৬ আনায় ১ ভরি, ৬ রতিতে ১ আনা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুরোনো অলংকার বিক্রি করতে আসা গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে। আবার নতুন কেনার পরিবর্তে পুরোনো অলংকার ভাঙিয়ে নতুন করে গড়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে স্বর্ণের দাম যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে পুরোনো অলংকার বিক্রি গ্রাহকদের জন্য লাভজনক। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম আবার আউন্সপ্রতি ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেটি হলে দাম ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, গত বছর যখন ২ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৮৫-৮৬ টাকা। বর্তমানে ডলারের দাম এক শর ওপরে। তাই দেশের বাজারে দামটা তুলনামূলক বেশি বেড়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩
এমএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।