বগুড়া: রমজান উপলক্ষে বগুড়ায় সরবরাহ বেড়েছে কলার। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চন্ডীহারা ও ফাঁসিতলায় কলার দুই মোকামে প্রতি হাটে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৬০ ট্রাক কলা।
সপ্তাহে দু’দিন বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে বসে কলার জমজমাট হাট। এ হাট থেকে ব্যাপারীরা কলা কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন।
শনিবার (১ এপ্রিল) সকালে জেলার চন্ডিহারা কলার হাট ঘুরে দেখা যায়, চাষি ও ব্যাপারীদের মধ্যে বেচাকেনার দৃশ্য। সপ্তাহের শনিবার ও বুধবার এখানে কলার হাট বসে। চলে সকাল ৬টা থেকে দুপুর পর্যন্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর থেকে মোকামে আসতে থাকে কলা বোঝাই ভ্যান-ভটভটিসহ বিভিন্ন পরিবহন। পরিবহন থেকে কলার কান্দি নামিয়ে হাটের নির্ধারিত স্থানে সাজিয়ে বসেন কলা চাষিরা। এরপর শুরু হয় কলা বেচাকেনার দাম। পাইকাররা কলা কিনতে চাষিদের ঘিরে দাম করতে থাকেন। চাষিদের সঙ্গে দাম ঠিক করে গাড়িতে তোলার জন্য কলার কাঁধি হাটের নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করা হয়। একপর্যায়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো মোকাম। দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
বগুড়া জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জাতের কলার চাষ হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে অনুপম, অমৃত সাগর, সবরি, কবরি, চাঁপা, মেহের সাগর, কাবুলি, বিচিকলা ও আনাজি কলা উল্লেখযোগ্য। তবে বগুড়াতে অনুপম, সাগর, সবরি, বিচিকলা, চাঁপা কলা বেশি চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া জেলার পল্লী এলাকায় দেশি কলার চাষও হয়ে থাকে। ভালো দামের কারণে অনেক চাষি কলা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
পর্যাপ্ত রোদ যুক্ত ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্পন্ন উঁচু দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উপযুক্ত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে কলার চারা রোপণ করা হয়। আশ্বিন থেকে কার্তিক, মাঘ থেকে ফাল্গুন এবং চৈত্র থেকে বৈশাখ এ তিন সময়েই কলার চারা রোপণ করা যায়। তবে আশ্বিন-কার্তিক মাসে রোপণ করা কলা গাছে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
চন্ডিহারা হাটে আসা শিবগঞ্জ ও সোনাতলা উপজেলার কলা চাষি সবুজ সওদাগর, রাকু ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, পেশায় তারা চাষি। বাজারে এখন কলার ভালো দাম পাওয়া যায়। যে কারণে অনেক চাষিরা কলা চাষে ঝুঁকছেন। তারা নিজেরাও কলা চাষ করেন এবং চন্ডিহারা ও ফাঁসিতলা মোকাম করেন। চন্ডিহারা মোকাম থেকে প্রত্যেক হাটবারে গড়ে ২০-২৫টি ট্রাক ও ফাঁসিতলা থেকে গড়ে ৩০-৩৫টি ট্রাকের মতো কলা বিক্রি হয়।
তারা বলেন, কলার মূল মৌসুম চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস। এ সময়ে মোকামে ব্যাপক পরিমাণ কলার আমদানি হয়ে থাকে। এ বাজারে শিবগঞ্জ, মহাস্থান, মোকামতলা, ফাঁসিতলা, গোবিন্দগঞ্জ, ঢাকুমারা, বালুয়া, রহবলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কলার আমদানি হয়। মৌসুমে কোনো কোনো হাটবারে প্রায় শতাধিক ট্রাক কলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায় বলেও মন্তব্য করেন তারা।
সদর উপজেলার তিতাস ও পদ্মা মোল্লা নামে কলা চাষি দুই ভাই বাংলানিউজকে জানান, তারা হাটে চাপা ও অনুপম কলা নিয়ে এসেছেন। এবার তারা প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে তিন বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। তারা দুই ভাই শনিবার সাহরি করে ভোর রাত ৪টা থেকে দুই শ্রমিক নিয়ে বাগানের উপযুক্ত কলার কাঁদি কাটার কাজ শুরু করেন। এরপর ভটভটিতে করে কলা নিয়ে হাটে আসেন। এবছর তাদের আবাদের বেশির ভাগ জমিতে ছিল অনুপম কলা।
তারা বলেন, এ জেলার চাষিরা প্রতি হাটে বাগান থেকে কলার কাঁধি আনার জন্য আগে থেকেই গাড়ি ভাড়া করে রাখেন। দূরত্ব অনুযায়ী চালকদের সঙ্গে ভাড়া মিটিয়ে নিতে হয়। কলার মূল মৌসুমে পরিবহন ভাড়ায় অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় তাদের।
পরিবহন ও শ্রমিক খরচের বিষয়ে তারা বলেন, প্রায় চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভটভটিতে করে হাটে কলা নিয়ে এসেছেন। এতে খরচ হয়েছে ৫শ' টাকা। এছাড়াও দুই শ্রমিককে দিতে হয়েছে ৮শ’ টাকা। শ্রমিকদের সঙ্গে তারা নিজেরাও পরিশ্রম করেছেন।
ঢাকার থেকে আসা পাইকার রশিদ তালুকদার বাংলানিউজকে জানান, বগুড়ার শিবগঞ্জের চন্ডীহারা ও ফাঁসিতলায় কলার প্রতি হাটে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক কলা পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতি ট্রাকে গড়ে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার কলা লোড হয়ে থাকে। তবে পরিবহন ভাড়া অতিরিক্ত হওয়ায় লাভের মুখ তেমন দেখতে পাই না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জেলার এ দুই মোকাম থেকে কলা রাজধানী ঢাকাসহ, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, লালমনিরহাট, টাঙ্গাইল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোরসহ বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা শহরে চলে যায়।
বর্তমানে প্রতি কাঁধি অনুপম কলা ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা, চাপা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা এবং সাগর কলা ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। সপ্তাহের শনি ও বুধবার বসে চন্ডীহারা হাট। সোম ও শুক্রবার ফাঁসিতলা। তবে বাজারের যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। কারণ বাজার বসার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। ফলে মহাসড়কের দু’পাশ দিয়ে স্থানীয়রা বাজার বসাতে বাধ্য হন।
স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, হাট থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়। কিন্তু হাটের কোনো উন্নয়ন হয় না। হাটের জন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা হয় না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, চলতি বছর কৃষকরা কলা চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর কলার ভালো ফলন হয়েছে। এখন সারা বছরই কলার চাষ হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৯ টন করে ফলন ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে শুধু বগুড়াতেই ফলন হবে প্রায় ২০ হাজার ৯০০ টন কলা।
এদিকে হাটের বেশির ভাগ কলা জাগ বা হিট দিয়ে পাকানো হয়। কোথাও আবার মেডিসিন দিয়ে কলা পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়। এখন হাটে গাছ পাকা কলা খুব কম পাওয়া যায়। খুচরা বাজারে বিভিন্ন এলাকায় এখন কলা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৪০ টাকা হালি। ছোট আকারের কলা ২৫ টাকা হালি এবং বড় ও মোটা আকারের কলা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা হালি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০২৩
কেইউএ/আরআইএস