ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

সারের দাম বাড়ায় চাপে কৃষক, সরবরাহ নিশ্চিতের তাগিদ

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৩
সারের দাম বাড়ায় চাপে কৃষক, সরবরাহ নিশ্চিতের তাগিদ

ঢাকা: সারের দাম বাড়ানোয় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এরপর ওপর আছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এ অবস্থায় সারের দাম বাড়ানোয় তারা চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন। সবকিছু মিলে কৃষি খাতে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। এদিকে সরকার বলছে, সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। আর এই দামে খুব সমস্যাও হবে না।

অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, সারের মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি সরবরাহ কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় বা ঘাটতি না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায়, সে জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে সারের সংকট হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটা কৃষক এবং ভোক্তার জন্য দুর্ভাবনার কারণ বেশি হবে।

তবে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কারণ নেই। অবশ্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দাম কিছুটা বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। অপরদিকে দাম ভালো পেলে কৃষকরা তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১০ এপ্রিলের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় সোমবার (১০ এপ্রিল) সারের মূল্যবৃদ্ধির এই আদেশ জারি করে এবং ওই দিনই পুনঃনির্ধারিত এ মূল্য কার্যকর হয়েছে।

সারের দাম বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়েছে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের মূল্য পুনঃনির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এতে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

একইভাবে ডিলার পর্যায়েও প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকার পরিবর্তে ১৯ টাকা, টিএসপি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, এই মুহূর্তে সরকার দেশে উৎপাদিত সারের থেকে আমদানিকৃত সার দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছেন। গ্যাসের সংকটের কারণে সার কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সারের ঘাটতি রয়েছে। সেটা আমদানি করে মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও সারের মূল্য বেশি। একই সঙ্গে সরকারের রিজার্ভে টানাপোড়েন রয়েছে। ফলে চাহিদা মাফিক সার আমদানি করা যাচ্ছে না। এদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সারে যে ভর্তুকি দেবে, সেই পরিস্থিতিও নেই। সে সব বিবেচনায় সারের মূল্যবৃদ্ধি না করে সরকারের কোনো উপায় ছিল না।

তিনি বলেন, কৃষকের জন্য হতাশাজনক হবে তখন যখন মূল্য বাড়ানোর পরও যদি পর্যাপ্ত সার না পাওয়া যায়। তবে অভিযোগও আছে চাহিদা অনুযায়ী সার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। কারণ নানা কারণে পর্যাপ্ত সার আমদানি করতে পারছে না। আর উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখতে সার আমদানি করতেই হবে সরকারকে। এজন্য রিজার্ভ থেকে যতটা খরচ করা যায়, সেটা সরকারকে করতে হবে। আর মূল্যবৃদ্ধি করে রাজস্ব মেটানোর চেষ্টা করা হবে।

সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু কৃষকদের ব্যয় বাড়বে। বোরোসহ সামনে যে ফসলের মৌসুম রয়েছে সেগুলোরও ব্যয় বাড়বে। ফলে সারের বাড়তি মূল্যে প্রভাব পড়বেই। তবে আমি মনে করি, সারকে বাড়তি মূল্য দিয়ে আমদানি করতে হলেও সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। কৃষকও বাড়তি মূল্য দিয়ে সার কিনতে প্রস্তুত থাকবেন। যদি তার জন্য যথেষ্ট সার সরবরাহ করা যায়। মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি সারের সরবরাহ কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় বা ঘাটতি না পড়ে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায় সে জায়গায় নিশ্চিত করতে হবে। নইলে সারের সংকট হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটা কৃষক এবং ভোক্তার জন্য দুর্ভাবর্নার কারণ বেশি হবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এছাড়াও দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প পণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এমনিতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। সেটি আরও বাড়বে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। আমরা চাইব, বীজ বা অন্যভাবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে। আমি চাইনি কোনোভাবেই সারের দাম বাড়ুক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিল যে, দাম বাড়াতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, সারের দাম না বাড়াতে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাড়াতেই হলো।

তিনি বলেন, কিন্তু দাম যা বেড়েছে, সেটাও বৈশ্বিক সারের যে দাম বেড়েছে সে তুলনায় বাড়েনি। এখনও সরকারকে সারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হবে। তবে বৈশ্বিক দাম কমে আসলে সারের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে বোরো ধানের আগ পর্যন্ত সারের চাহিদা বেশি থাকে এরপর সারের চাহিদাও কমে আসবে। তাই এই দামে খুব সমস্যা হবে না।

কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কিনা-তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি এবং অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে লোকসান হবে। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রমের মূল্য যুক্ত করলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে। যেসব জেলায় বেশি ধান উৎপাদন হয়, তার মধ্যে দিনাজপুর অন্যতম। সারের দাম বাড়ানোয় দুশ্চিন্তার কথা বলছেন এই জেলার কৃষকরা। তাদের মতে, এক একর জমিতে এবার আমন আবাদ করতে খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকা এবং বোরোতে আরও বেশি। এখন আবার দাম বাড়াতে আমরা আর লাভের মুখ দেখবো না।

সোনারগাঁওয়ের সবজি ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, সবজি চাষ করে সংসার চলে। সারের যে দাম বেড়েছে তাতে বস্তায় ২৫০ টাকা বাড়বে। এর আগের বছর বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। যদি বছর বছর সারের দাম বাড়ে তাহলে ক্ষেত্ করা যাবে না। তবে সারের দাম বাড়ার সাথে সাথে যদি সারের সরবরাহ ঠিক থাকে আর ফসলেরও দাম বাড়ে তাহলে সমস্যা হয় না। কিন্তু আমরা কষ্ট করে উৎপাদন করি দাম পাই না। এভাবে চলতে থাকলে আবাদ কমিয়ে দিতে হবে। প্রতিবছর লোকসান দিতে পারবো না।

করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটময় পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে কৃষি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়কে ২৪ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতিপ্রকৃতি তাতে ভর্তুকি ব্যয় আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মোট জমি কম হলেও সম্প্রতি কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পর্যায়ে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়। পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং মোট ফল উৎপাদনে আঠাশতম স্থান অর্জন করছে।

কৃষিতে সাফল্য বিবেচনায় প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চালের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ শতাংশ, গমের ৪৫ শতাংশ, ভুট্টার ৭৭৫ শতাংশ, আলুতে ১০১ শতাংশ, ডালে ৩৭৫ শতাংশ, তেলবীজে ৮১ শতাংশ, সবজির ক্ষেত্রে ৫৭৮ শতাংশ যা বিশ্বে অভাবনীয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে ৫ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতি কেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

বিগত তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩-৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশে সারে প্রদত্ত সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০২০-২১ অর্থ বছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৪২০ কোটি টাকা, সেখানে ২০২১-২২ অর্থ বছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সারে ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের এখন পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।