ঢাকা: নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। কমছে না একেবারেই।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি ব্যবস্থা থাকলেও এর সুফল দেখা যাচ্ছে না। কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। ফলে সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কিছুদিন আগেও ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁপের দাম বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে সবজি কেনাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
# সরকারি হিসেবে এক বছরে খাদ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ
# ৪৮ খাদ্যপণ্যের মধ্যে গেল এক বছরে বেড়েছে ৩৭টির ও এক মাসে বেড়েছে ১৫ টির দাম
# পেঁয়াজের কেজিতে বেড়েছে ১৫ টাকা
# রসুন বেড়েছে ৫০ টাকা
# ডজনপ্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ২০ টাকা
দিন দিন মূল্যবৃদ্ধির তালিকার বহর আরও দীর্ঘ হচ্ছে। পেঁপে, লাউ, করলা, উস্তার মতো সবজি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আমিষের উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের দামও বেড়েছে। এমনকি চিনি কিনতেও ক্রেতাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনির দাম এখন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।
শুক্রবার (৫ মে) রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মেরাদিয়া হাট, মালিবাগ বাজার, গোড়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার এবং সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে দাম বাড়ার এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরকারি তথ্যমতে, আলু, দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ, দেশি রসুন, দেশি ও আমদানি করা আদা, জিরা, দারুচিনি, তেজপাতা, চিনি এবং ডিমের দাম বেড়েছে।
অন্যদিকে সরু ও মাঝারি চাল, বড় ও ছোট মশুর ডাল, আমদানি করা রসুন, দেশি হলুদ, ধনে এবং ব্রয়লার মুরগীর দাম কমেছে।
পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দামও বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। ঘোষণা দিয়ে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৯৯ টাকায়।
এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ দাম বেড়েছে আমদানি করা আদায়, যা বর্তমানে প্রতিকেজি ১৮০-৩২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও আমদানি করা আদার দাম ছিল মাত্র ৭০ থেকে ১২০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৪৮ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে। সংস্থাটির গত এক বছরের খুচরা বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসময়ের ব্যবধানে বাজারে ৪৮ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ৩৭টির দাম। কমেছে শুধু ১০টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে শুধুমাত্র ১টি পণ্যের দাম।
এর মধ্যে গত এক বছরে দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে আছে মোটা স্বর্না চাল। এ চাল গেল এক বছরে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে মোটা স্বর্না চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৬-৫০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৪৫-৪৮ টাকা।
আর গত এক বছরে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে আমদানি করা আদা। এর দাম গেল এক বছরে বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিকেজি আদা ১৮০ থেকে ৩২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগেও ছিল মাত্র ৭০ টাকা থেকে ১২০ টাকা।
পাশাপাশি সংস্থাটির গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে ৪৮টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গেল এক মাসে বেড়েছে ১৫টির দাম। কমেছে ৯টি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ২৪টির।
এর মধ্যে গত এক মাসে টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, দাম বাড়ার তালিকায় নিচের দিকে অবস্থান গরুর মাংসের। গেল এক মাসে এর মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংসের দাম ৭৩০-৭৫০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৭০০-৭৫০ টাকা।
আর গেল এক মাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে দেশি নতুন রসুন। গেল এক মাসে এর দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশি নতুন রসুনের দাম কেজিপ্রতি ১৩০-১৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল মাত্র ৮০ থেকে ১২০ টাকা।
বাজারে হঠাৎ দেশি রসুনের দাম বেড়ে যাওয়াতে ক্রেতারা একপ্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মূলত কোরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের।
দাম বাড়ার তালিকায় বাদ যায়নি অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ডিম। এ ছাড়া শিশুখাদ্য হিসেবে ডিমের চাহিদা অনেক। মধ্যবিত্ত পরিবার মাছ-মাংসের চাহিদা কমিয়ে ডিমের ওপর নির্ভর করলেও এখন সেখানে মূল্যবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে প্রতি হালি (লাল) ডিমের দাম ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সপ্তাহ খানেক আগে ১২০-১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিম বর্তমানে এলাকা ভেদে ১৫-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৮ টাকা পর্যন্ত।
ডিমের বাজার কেন বারবার অস্থিরতা বাড়ছে এ বিষয়ে কয়েকজন পল্ট্রি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে ডিমের দাম আরও বাড়বে। মুরগির খাবারের দাম বাড়ায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। যার প্রভাব ডিমের বাজারে দেখা দিচ্ছে। লোকসানের কারণে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী লোকসান কমাতে খামারের আকার ছোট করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে আগামী কিছুদিনের মধ্যে ডিমের দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি হিসেবে, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে খোলা আটা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫৫-৫৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাশাপাশি প্যাকেট আটা ২০ টাকা বেড়ে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন তা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। ফলে যারা খেটে-খাওয়া মানুষ আছে তাদের একপ্রকার কষ্ট বেড়ে গেছে।
সবজির বাজার:
এ সপ্তাহে সবজির বাজারে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় আছে, পেঁপে, লাউ, করলা, উস্তা, লতি, বরবটি, ধুন্দল, সজনে এবং কাকরোল। আর অন্যান্য সব সবজির দাম আগের মতোই আছে। প্রতি কেজি সজনে বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকায়। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। ১ কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৩৫-৪০ টাকা। প্রতি কেজি লতি, করলা, উস্তা, চিচিঙ্গা, বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ১০০-১২০ টাকা।
কম দামি সবজির মধ্যে, প্রতি কেজি পাকা টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকায। মিষ্টিকুমড়া প্রতি পিস কাঁচা ৪০ এবং পাকা ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় আলু প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকায়। লেবু হালি ৩৫-৪০ টাকা। আর সব ধরনের শাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়।
খিলগাঁও বাজারের সবজি বিক্রেতা ফজলে রাব্বি বাংলানিউজকে বলেন, সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। আগের মত তেমন সবজি পাওয়া যায় না। পাইকারি পর্যায়ে বেশি দামে বিক্রি করে। তাই আমরা যারা খুচরা ব্যবসায়ী আছি আমাদেরও বাধ্য হয় বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। আর লাভ ছাড়া তো বেচে না কেউ। তবে আগে মানুষ যে পরিমান সবজি কিনত এখন আর সে পরিমান কেনে না। দাম বাড়ায় ক্রেতারা কম করে সবজি কেনেন। আর দাম বাড়লেও আমাদের আগের মতো ব্যবসা হয় না।
মসলার বাজার:
দেশি পেঁয়াজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায় যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৫- ৪০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে দেশি নতুন রসুনের দাম কেজিপ্রতি ১৩০-১৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল মাত্র ৮০ থেকে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২২০ টাকা এবং চায়না বা আমদানি আদা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা। প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকায়। শুকনা মরিচ ইন্ডিয়ান প্রতি কেজি ৪২০ টাকা এবং দেশি শুকনা মরির প্রতি কেজি ৩৭০ টাকা। হলুদ গুঁড়া কেজি ২৫০ টাকা, গুঁড়া মরিচ কেজি ৪৫০ টাকা, ধনিয়া প্রতি কেজি ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাল ও ডালের বাজার:
সপ্তাহের ব্যবধানে চাল ও ডালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আটাশ চাল ৫৫ টাকা, মিনিকেট চাল ৭২, গুটি স্বর্ণা চাল ৫০, নাজিরশাইল ৮০ টাকা, পাইজাম চাল ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মশুর ডাল দেশি প্রতিকেজি ১২৫-১৩৫ টাকা এবং আমদানি মশুর ডাল ৯৫ -১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এঙ্কর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা। মুগ ডাল প্রতি কেজি ১৩০ টাকা।
আমিষের বাজার:
সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দামে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রতিকেজি ব্রয়লার ২৪০ টাকা, লাল মুরগী প্রতিকেজি ৩৫০ টাকা, বড় সাইজের সোনালী এবং কক মুরগী প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৩৬০ টাকায়। দেশি পাতিহাঁস প্রতি পিছ ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস হাড়সহ ৭৩০-৭৫০, খাসির মাংস ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত। ছাগলের মাংস ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে আধাকেজি ওজনের বেশি ইলিশের দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এক কেজি বা তার ওপরের ওজনের ইলিশের দর ১৬০০ টাকা। এক কেজি ওজনের রুই মাছের দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। কাতল মাছের কেজি ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। কাচকি মাছ ৪৫০-৫০০ টাকায়, ট্যাংরা ৬০০-৭০০ টাকা, আইড় মাছ ৭০০ টাকা, বাগদা চিংড়ি ৬০০ থেকে ৭০০ টাক কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পাঙ্গাশ মাছ ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। সিলভার কাপ ২০০ টাকা, পোয়া ৪০০ থেকে বাজার ভেদে ৪৫০ টাকা। কার্ফু মাছের কেজি ২৫০ থেকে বাজার ভেদে ৩০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, মে ৫, ২০২৩
ইএসএস/এসএএইচ