ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

খাবার খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২৩
খাবার খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রী নাই, বাস বন্ধ, নিজ নিজ কাউন্টারের সামনে অলস সময় পার করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: সরকার পতনের এক দফা দাবিতে একের পর এক অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট।  

অবরোধ সফল করতে বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে দেওয়া হচ্ছে আগুন।

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না সাধারণ মানুষ, এড়িয়ে চলছে গণপরিবহন।

খোদ রাজধানীতেই গণপরিবহন চলাচল করছে সীমিত আকারে। সেই তুলনায় হাতে গুনে চলছে দূরপাল্লার বাস। এতে দুই বেলা খাবার খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

বুধবার (৮ নভেম্বর) রাজধানীর মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, টার্মিনালের ভেতরে বসে গল্প করে সময় কাটছে চালক-হেলপারদের। কয়েক ঘণ্টা পর পর একটি-দুটি করে বাস ছাড়লে দু-একজন করে উঠে যাচ্ছেন। বাকিরা আগের মতোই অলস বসে আছেন।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, অবরোধে এই টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যাওয়া বাসের সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের এক চতুর্থাংশ। বড় বড় কিছু কোম্পানির বাস এভাবে চললেও ছোট কোম্পানির বাসগুলো একেবারেই বন্ধ রয়েছে। মূলত যাত্রী না থাকায় স্বাভাবিক নিয়মে বাস ছাড়তে পারছেন না তারা। ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় খুবই কম আয় হচ্ছে তাদের। কেউ কেউ একেবারেই বেকার বসে আছেন।

অথচ প্রতিদিন একজন চালক বা হেলপারকে খাওয়া-দাওয়া বাবদ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ঠিকই খরচ করতে হচ্ছে। কেউ কেউ সেই টাকা তুলতে পারলেও বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিককে জমানো টাকা বা ধার-দেনা করে দৈনিক খরচ চালাতে হচ্ছে।

অবরোধে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা পরিবহনের বাস সবচেয়ে বেশি ছেড়ে যেতে দেখা যায়। এই টার্মিনাল থেকে তারা ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার রুটে যাত্রী সেবা দিয়ে থাকেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এই বাসের একেকজন চালক, হেলপার যেখানে স্বাভাবিক সময়ে একটি রাউন্ড ট্রিপসহ তিনটি ট্রিপ দিতে পারতেন, সেখানে এখন বড়জোর একটি সিঙ্গেল ট্রিপ বা দুই দিনে একটি রাউন্ড ট্রিপ দিচ্ছেন। প্রতি ট্রিপে একজন চালক পান ৫৭০ টাকা এবং একজন হেলপার ও একজন সুপার ভাইজার পান ২৬০ টাকা করে। সেই হিসেবে একজন হেলপার বা সুপারভাইজার দুই দিনে যেই টাকা আয় করছেন, সেটি দিয়ে ব্যয় মিটছে একদিনের।

এনা পরিবহনের সুপারভাইজার শাহীন বলেন, অবরোধের সময় প্রতিদিন একটি করে ট্রিপ দিতে পেরেছেন তিনি। প্রতিদিন আয় হয়েছে ২৬০ টাকা করে। কিন্তু খরচ হয়েছে প্রায় ৪০০ টাকা করে। বাধ্য হয়ে জমানো টাকা থেকেই খাবার দাবারের খরচ মেটাচ্ছেন তিনি। বাড়িতে তার মা, বাবা, ভাই, বোন থাকলেও তাদের জন্য কোনো টাকা পাঠাতে পারছেন না। বরং উল্টো পরিবারের কাছ থেকে টাকা আনতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, করোনার সময় একবার কয়েক মাস বসে থাকতে হয়েছে। সেই ধাক্কাই এখনো সামলে উঠতে পারেননি। এখন আবার হরতাল অবরোধের ধাক্কা এসে পড়েছে।

এনা পরিবহনের বাস সীমিত আকারে চললেও সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বগুড়া রুটে চলাচলকারী লাবিবা পরিবহনের বাস অবরোধে পুরোই বন্ধ রয়েছে।  

এই বাসের চালক মো. নয়ন খান বলেন, সাতদিন ধরে বসে আছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে একবার বাস নিয়ে গেলে সব খরচ দিয়ে অন্তত ১৪ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু যাত্রী নেই। খরচের টাকা না তুলতে পারায় মালিক বাস বন্ধ রেখেছে। ফলে আয় পুরোপুরি বন্ধ। অনেক চালক বসে আছে। টাকা না পেলে আমরা চলবো কীভাবে? দৈনিক অন্তত দুই বেলা খেতে ৩০০ টাকা লাগে। সেই টাকাও পাচ্ছি না। ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে।

মো. দুলাল নামের আরেক চালক বলেন, আমরা কোনোমতে খেতে পারলেও স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছু পাঠাতে পারছি না।

আরেক চালক মো. খোকন বলেন, পরিবহন খাতের ওপরই কেন এত অত্যাচার। অবরোধে সবকিছুই চলছে, সব কিছু খোলা রয়েছে। শুধু আমাদের পরিবহনের ওপর যত হামলা-অত্যাচার। যাত্রীরা ভয়ে আসছে না, আমরাও বাস ছাড়তে পারছি না।

ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটে চলাচলকারী বিনিময় পরিবহনের চালক মো. আকতার হোসেন বলেন, অবরোধের শুরুতে বোনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। সেটি দিয়ে পরিবার চলছে। নিজে সহকর্মীদের কাছ থেকে ধার করে ভাত খাচ্ছি। প্রতিদিন খাবার খরচ লাগে ৩৫০-৪০০ টাকা। কিন্তু আয় নেই এক টাকাও। কারণ বাস চালাতে পারছি না।

শুধু পরিবহন শ্রমিকদেরই এই দুর্দশা নয়। টার্মিনালকেন্দ্রিক যেসব ভাসমান ব্যবসা রয়েছে তাদেরও একই অবস্থা। মহাখালী টার্মিনালে চিপস-বিস্কিট, চা, সিগারেট বিক্রি করেন সোহেল।  

তিনি বলেন, আগে প্রতিদিন ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হতো। এখন প্রতিদিন ৩-৪ হাজার টাকার বেশি হয় না। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৩০০ টাকা বিক্রি করেছি। যাত্রী নেই। তাই দোকান বন্ধ করে চলে যাচ্ছি। বিকালে আবার খুলব।

প্রায় ৪০ বছর ধরে এই টার্মিনালে ফেরি করে বিভিন্ন ধরনের পিঠা বিক্রি করেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ কহিনুর ব্যাপারি।  

তিনি বলেন, প্রতিদিন হাজার- ১২০০ টাকার পিঠা বিক্রি করে ৫০০-৬০০ টাকা লাভ থাকতো। কিন্তু এখন ১০০-১৫০ টাকাও বিক্রি নেই। আমার কাছ থেকে মূলত পরিবহন শ্রমিকরাই পিঠা কিনে খায়। বাস না চলায় তাদের কাছেই টাকা নেই। আমার কাছ থেকে কিনবে কি?

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারাদেশে চলছে বিএনপি-জামায়াত এবং বিভিন্ন সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের তৃতীয় দফার অবরোধ। বুধবার (৮ নভেম্বর) সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধ চলবে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২৩
এসসি/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।