ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি, সাধারণের নাভিশ্বাস

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৩
হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি, সাধারণের নাভিশ্বাস

ঢাকা: নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতেই রাজনীতির মাঠে সংঘাত-সহিংসতা-নাশকতার চিরচেনা চিত্র যেন ফিরে এসেছে। বিশেষ করে ২৯ অক্টোবরের হরতাল এবং এর একদিন পর থেকে অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এই সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আরও বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এমন পরিস্থিতিতে আগে থেকেই সংকটে থাকা অর্থনীতি আরও সংকটে পড়ছে।

অর্থনৈতিক মন্দায় বিনিয়োগসহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক-বীমা-পুঁজিবাজারে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থিক খাতগুলো ছাড়িয়ে শিক্ষাসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, রাজনীতির আগুনে মানুষের সঙ্গে পুড়ছে অর্থনীতিও। অবরোধ ও হরতালে পরিবহন, কৃষি, পোশাক ও উৎপাদন শিল্পসহ অন্য খাতগুলোর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদনসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। একই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা পুঁজিহারা হচ্ছেন। রাজনৈতিক এই অস্থিরতা বাড়লে বা দীর্ঘায়িত হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হবে। ফলে হরতাল-অবরোধের নামে এমন অর্থনৈতিক বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা না হলে এই মন্দা আরও বাড়ার পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।

বিএনপির ডাকা ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনের অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্তত ৩২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এছাড়া যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত ২৫ কোটি টাকা। পণ্য পরিবহনের বাড়তি খরচ ও কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি বলে জানান তারা। আর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র শঙ্কা, এ অবস্থা চললে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এছাড়া এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এ ধরনের নৈরাজ্য আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। এতে আমদানি-রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া সারা দেশে পণ্য সরবরাহের স্বাভাবিক চেইন ভেঙে পড়তে পারে। আর এতে নতুন করে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও একধাপ বাড়ে। আর কাঁচামাল সরবরাহের সিডিউল ধরে রাখতে না পারায় শিল্পকারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে।

জানা গেছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিল তখনই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যার কঠিন প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় আমদানিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এছাড়া ডলার সংকটে স্থবির হয়ে পড়ে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানিসহ বৈদেশিক লেনদেন। এলএনজি ও গ্যাসের সংকটে অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদন কমতে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এই নাভিশ্বাস ওঠা পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে অবরোধ-হরতাল, ভাঙচুর-আগুন অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে বড় কাজ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সরবরাহ বাড়ানো এবং রিজার্ভের পতন আটকানো। কিন্তু রপ্তানি আয়, প্রবাস আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান কমছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রা বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও বহির্গামী রেমিট্যান্স পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

করোনা মহামারির সময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়ে সরকার সংকট কাটিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে সক্ষম হয়। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন করে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন অর্থনীতিতে বড় আঘাত লাগলে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, হরতাল বা অবরোধে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা বা অস্থিরতায় পণ্য আমদানি রপ্তানি ব্যাহত হয়। পণ্য পরিবহণ, উৎপাদন ব্যাহত হয়। এরফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কম হয়। এতে করে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। কেননা অবরোধে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। এছাড়া দেশে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় উদ্বেগজনক হারে কমবে। এতে ডলার সংকট আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাবে। রিজার্ভের পতনে নতুন গতি পাবে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

সাবেক এই অর্থ-উপদেষ্টা বলেন, এখন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একটা সমঝতা করতে হবে। নইলে সংঘাতময় এই রাজনীতি অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচন এলেই এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যার খেসারত দিতে হয় পুরো দেশকে। এবারও সংঘাত দেখা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে–এই সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সংঘাত চরম আকার নিলে তার অর্থনৈতিক প্রভাব হবে ব্যাপক। কারণ এবার অন্যান্য সময়ের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ দুর্বল, বৈশ্বিক অবস্থাও পক্ষে নেই।

তিনি বলেন, গত কয়েক দিন ধরে যেভাবে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলার সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। অর্থনীতির সব খাতেই তৈরি হবে একটা বিরূপ পরিস্থিতি। গত মাসে রপ্তানি কমেছে, আগামীতে আরও কমবে। ফলে নির্বাচনের ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি হয়তো চলতে থাকবে, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণাম হবে ভয়াবহ। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মনোভাবে নমনীয়তার লক্ষণ নেই। যেকোনোভাবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই হতে হবে।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলেন, উৎপাদনে ব্যবহৃত মূলধনি আমদানি কমে আসার প্রবণতা বেশ উদ্বেগজনক। মূলধনি আমদানি কমে যাওয়া মানে উৎপাদন কমে যাবে। এর ফলে রপ্তানি আরও কমবে। রপ্তানির মাধ্যমে এখন যে পরিমাণ ডলার আসে, তা না আসা মানে রিজার্ভে আরও টানাপোড়েনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রপ্তানি খাত। মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলার আসে পণ্য রপ্তানি থেকে। অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি কমছে আগের অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশের মতো। মাসটিতে ৩৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। গত বছরের একই মাসের চেয়ে যা ৬০ কোটি ডলার কম। গড়ে প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এ হিসাবে অক্টোবরে ১২৪ কোটি ডলার কম রপ্তানি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের শঙ্কা, গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে দায়ী করছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।

এদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমছে প্রায় ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাকের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি কম হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। পোশাক উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানি কম হয়েছে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩৯ শতাংশ। সুতা, কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামালও প্রায় একই হারে কমেছে। পোশাকের বাইরে অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি কম হয়েছে ৩৬ শতাংশেরও বেশি। কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া মানে হচ্ছে, উৎপাদন কমে যাওয়া। উৎপাদন কমে যাওয়া মানে রপ্তানি কমে যাওয়া। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝা যায় মূলধনি যন্ত্রের আমদানি চিত্রে।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ৩৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সর্বশেষ অক্টোবরে রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। প্রবাস আয় অক্টোবরে বাড়লেও এর আগের তিন মাসে কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, যা বিনিয়োগে ধীরগতির লক্ষণ। সর্বশেষ শ্রম জরিপ অনুযায়ী কমেছে কর্মসংস্থানও।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।